ঢাকা : গত ৩ এপ্রিল বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১)। হাতটি বেরিয়ে ছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটিকে পেরিয়ে যাওয়ার বা ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিকে গা ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শমরিতা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর রাজীবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়।
ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা শুরুর পর বেশ উন্নতি করছিলেন রাজীব। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। খুব দ্রুতই নিয়তির কাছে হার মানতে হয় রাজীবকে। সে সঙ্গে মৃত্যু হয় একটি স্বপ্নের।
বাবা-মা হীন এক জীবন যোদ্ধার এ অকাল প্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে ভেতরে ভেতরে ডুকরে কেঁদেছেন তার চিকিৎসকরাও। বুকের ভেতর হাহাকার অনুভব করেছেন তারা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান ও রাজীবের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান মো. শামসুজ্জামান সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আপনারা একটু লেখালেখি করেন। এমন মৃত্যু ঠেকানোর দায়িত্ব আমার, আপনার, সমাজের, রাষ্ট্রের। এসময় চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজীবের শারীরিক অবস্থার কথা তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, রাজীব নেই। আমরা খুব কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু রাজীবের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে ত্রুটির কারণে এমন মৃত্যু, সেই ত্রুটিগুলো সারানো দরকার। আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত হয়ে আসতেন। এখন সংখ্যায় অনেক বেশি। এই যে আজ ভর্তি হয়েছে একটা বাচ্চা। জীবন বাঁচাতে তার পা কেটে ফেলতে হলো।
রাজীবের এমন মৃত্যুর জন্য সড়ক দুর্ঘটনাকে দোষারোপ করে তা প্রতিরোধে প্রত্যেককে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা একটু লেখালেখি করেন। এমন মৃত্যু ঠেকানো সবার দায়িত্ব আমার, আপনার, সমাজের রাষ্ট্রের। এই যে রাজীব, খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা মা নেই। সংগ্রাম করে জীবন চালাচ্ছিল। ছোট ছোট দুটো ভাই।
রাজীবকে হাসপাতালে আনার পর থেকে চিকিৎসকদের তৎপরতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যেদিন ওর ছবি পত্রিকায় ছাপা হলো সেদিন সকালেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবে হোক ওকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসতে হবে। ততক্ষণে ওর অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে। আমরা বললাম আউটডোর দিয়ে আসতে সময় লাগবে, জরুরি বিভাগ দিয়ে দ্রুত ভর্তি করার ব্যবস্থা করলাম। বোর্ড হলো। দেখলাম অস্ত্রোপচারটা ভাল হয়েছে। শমরিতায় যে করেছে ও আমাদেরই সহকারি অধ্যাপক। দেখলাম ওর মাথার সামনের দিকে আঘাত আছে। সাতজনের বোর্ডে দুজন নিউরোসার্জন ছিলেন। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন আছে কি না সে নিয়েও আলোচনা করলাম। সিটি স্ক্যান রিপোর্ট ভাল। অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়নি।
শুরুতে রাজীবের প্রাণহানির আশঙ্কা ততটা ছিল না উল্লেখ করে অধ্যাপক মো. শামসুজ্জামান বলেন, রাজীব সে সময় স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে। আমরা চিকিৎসায় সারিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। ভাল সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল। সবই ঠিকঠাক। গত সোমবার রাত ১২টা পর্যন্ত সব ঠিক। রোগী ধীরে ধীরে ভাল হয়ে উঠছে। সেদিন বিকেলে করা সিটি স্ক্যান রিপোর্ট তাই বলে। হঠাৎ মঙ্গলবার ভোর চারটায় ওর শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করল। কোনো কারণে গলায় কিছু বেধে গেল কি না তাও দেখা হলো। পরে নেবুলাইজেশন দেওয়া হলো। রাজীব স্বাভাবিকভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছিল। তারপর আবারও খারাপ হতে শুরু করল। আমরা ওকে ভেন্টিলেশনে দিলাম। আমরা ওর ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি। দ্রুত সিটি স্ক্যান করা হলো। কী বলব! আগের দিনের রিপোর্টের ঠিক উল্টো। একদম খারাপ।
তিনি বলেন, ওর (রাজীব) মস্তিষ্ক এত ভাল কাজ করছিল যে, আমরা অপারেশনে যাইনি। আর যখন খারাপ হলো, এত খারাপ হলো যে, অপারেশনের আর সুযোগ পাওয়া গেল না। মস্তিষ্কের যে অংশটা অক্সিজেন সরবরাহের কাজ করে সেটা চাপ খেয়ে গিয়েছিল। মাথার সামনের দিকের আঘাতের জন্য ওই অংশটা ফুলে উঠেছিল। মাথার মাঝখানটা কাজ করতে পারছিল না। বিএসএমএমইউ এর ভিসি কনককান্তি স্যার নিজে আসলেন। দেখে বললেন, এখন অস্ত্রোপচারে আর কাজ হবে না। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
এরপরও আশা ছেড়ে দেননি জানিয়ে অধ্যাপক শামসুজ্জামান বলেন, তারপরও আমি আশা করেছিলাম। অল্প বয়স, হয়তো ফিরবে। আমরা ওর কিডনি, ফুসফুস, হৃদযন্ত্রটা যেন ঠিক ভাবে কাজ করে সেদিকে নজর দিচ্ছিলাম। ঠিকঠাক কাজ করছিলও। বৃহস্পতিবার কিডনিটা ঠিক মতো কাজ করছিল না। পরে সেটাও ঠিক হলো। গত পরশু দেখলাম, জ্বর। ফুসফুসে প্রদাহ থেকে জ্বরটা এসেছিল। এই লক্ষণ খুব খারাপ।
তিনি বলেন, শেষ সময়ে সাপোর্ট দেওয়ার পরও ফুসফুস কাজ করছিল না। ফুসফুস রক্তে অক্সিজেন নিতে না পারলে হৃদযন্ত্র কাজ করে না। একসময় হৃদযন্ত্রটা বিকল হয়ে গেল। মারা গেল রাজীব। ওর মস্তিষ্কটা যদি ধীরে ধীরে অসাড় হতে থাকত, তবু চেষ্টা করা যেত। হরদম ঢাকা মেডিকেলে এমন অস্ত্রোপচার হচ্ছে। একঘণ্টা লাগে এমন অস্ত্রোপচারে। সব প্রস্তুতি ছিল, রাজীব সুযোগটাই দিল না।
কথাগুলো বলতে বলতে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন অধ্যাপক মো. শামসুজ্জামান।
গো নিউজ২৪/আই