ঢাকা বুধবার, ১৫ মে, ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কেন দিন দিন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে ভারতীয় মুসলিমরা?


গো নিউজ২৪ | আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০১৭, ১২:২২ পিএম
কেন দিন দিন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে ভারতীয় মুসলিমরা?

ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৭০তম বার্ষিকী পালন করে ফেলেছে ভারত। আর এরইমধ্যে দেশটিতে প্রকট হয়ে উঠেছে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের বিষয়টি। ৭০ বছর পরে এসেও থেকে গেছে সাম্প্রদায়িক চিন্তা। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ সম্ভবত বর্তমান মোদি সরকার। ২০১৪ সালে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর আরো ভয়াবহভাবে ভারতে বেড়েছে মুসলিম নিগ্রহ।

এক গরু নিয়ে ভারতে মুসলিমদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা কল্পনাতীত। গরু জবাই করেছে, বা মাংস সংরক্ষণ করেছে- শুধু এমন গুজবের ওপর ভিত্তি করে গণপিটুনি দিয়ে মুসলিম হত্যার ঘটনা ঘটেছে দেশটিতে। হিন্দু ধর্মে গরুকে দেখা হয় দেবতা হিসেবে। এ পর্যন্ত ভারতের অনেক রাজ্যেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে গরু জবাই। হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগুরু দলতন্ত্রের দাপটে মোদি সরকার এখন ভারতে থাকা বাংলাদেশি ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

ভারতের সদ্যবিদায়ী উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির কথায় ভালো বোঝা গেছে সেখানকার সাম্প্রদায়িকতার সাম্প্রতিক রূপ। বিদায়ী ভাষণে তিনি বলেন, ‘অসহিষ্ণুতা, গণপিটুনিতে হত্যা, গোমাংসে নিষেধাজ্ঞা, লাভ জেহাদ, যুক্তিবাদীদের খুনের মতো ঘটনা ভারতীয় মূল্যবোধের পরিপন্থি। শুধু তাই নয়, স্ব-ঘোষিত আইনরক্ষকদের দাপটে  মুসলিমদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে ভারতে। তারা ভারতের নাগরিক কি না- তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে।’

শুধু তিনিই নন; ধর্মের নামে যারা বিদ্বেষ ও রক্তপাতের রাজনীতি করে তাদের একহাত নিয়ে তৃণমূল সাংসদ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর পৌত্র সুগত বসু সংসদে দেয়া বক্তব্যে ভারতের ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে মহাত্মা গান্ধীর বার্তা স্মরণ করিয়ে দেন। স্মরণ করিয়ে দেন ১৯৪৭ সালের নভেম্বরের কথা, যখন গান্ধী বলেছিলেন, কোনো মুসলিম যেন ভারতে নিরাপত্তার অভাববোধ না করেন। একটি সম্প্রদায় বা ভাষা যেন অন্য সম্প্রদায় বা ভাষার ওপর জোর খাটাবার চেষ্টা না করে।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী

অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদি বিজেপি নেতা ভেঙ্কাইয়া নাইড়ুর উপরাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর যে বক্তব্য রাখেন, তাতে শোনা গেছে ঠিক এর উল্টো সুর। পর্যবেক্ষক মহল এমনটাই মনের করছেন। বক্তব্যে মোদি বলেন, আগামী পাঁচ বছর হবে তার দেশের রূপান্তর পর্ব। প্রসঙ্গত, ভারতের সাংবিধানিক পদগুলোর প্রায় সবই বর্তমানে মৌলবাদী হিন্দু সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) দখলে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে আরএসএসের সদস্য, বর্তমান প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দও একই সংগঠনের সদস্য। এছাড়া উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইড়ু ও দেশটির লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনও আরএসএস সদস্য। এতে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ আরো বেড়েছে- এটা কি হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত? কারণ ইতোমধ্যেই আঙুল উঠেছে একাংশের দেশাত্মবোধের দিকেও।

বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মাদ্রাসাগুলোতে ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপন এবং জাতীয় সংগীত গাওয়ার ভিডিও তুলে রাখা বাধ্যতামূলক করেছে মোদি সরকার। এ নিয়ে ভারতের মাদ্রাসাগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র অসন্তোষ। তাদের প্রশ্ন, ভারতীয় মুসলিমদের দেশাত্মবোধের পরীক্ষা নেয়ার জন্যই কি এই নির্দেশ। নাহলে সংস্কৃত স্কুল, সরকারি স্কুল বা অন্যান্য সম্প্রদায়ের পরিচালিত স্কুলগুলো বাদ দিয়ে বেছে বেছে শুধু ১২ হাজার মাদ্রাসার জন্যই এই নির্দেশ কেন? 

সর্বভারতীয় উলেমা ফোরামের আহবায়ক সুহেবুর রেহমান বলেন, ‘বিজেপি সরকার শুধু ভারতীয় মুসলিমদের কাছেই দেশাত্মবোধের প্রমাণ চেয়েছে।’ অবশ্য জাতীয় সংগীত গাওয়ার বিষয়ে উলামাদের আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে, ভারতের জাতীয় সংগীতে এমন কিছু কিছু কথা আছে, যা ইসলামবিরোধী। ‘ভারত মাতা কি জয়’ কথাটিও বলতে নারাজি আছে তাদের। পরিবর্তে কবি ইকবালের ‘সারে যাহা সে আচ্ছা’ গানটি নিয়ে আপত্তি নেই তাদের।

এদিকে ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশি এবং মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে তৎপর হয়ে উঠেছে মোদি সরকার। ভারত সরকারের মতে, প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি এবং ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রয়েছে। এক সমীক্ষায় বলা হয়, বহুদিন ধরে বাংলাদেশিরা গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে গিয়ে ধীরে ধীরে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড জোগাড় করে নিয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। এক্ষেত্রে তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব কিনা- এই প্রশ্নের উত্তরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংস্থার দক্ষিণ এশীয়া বিভাগের প্রধান মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যদি তাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে সম্মত হয়, তাহলে সেটা একটা প্রক্রিয়া হতে পারে।

তিনি আরো বলেন, ‘আজকাল যেটা দেখা যায়, সীমান্ত পার হতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশি ধরা পড়েন এবং নথিপত্র না থাকায় তাদের ছয় মাস থেকে দুই বছর জেল হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর ঢাকা স্বভাবতই তাদের নিজ নাগরিক বলে মানতে চায় না। সেক্ষেত্রে তারা না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় থাকেন।’

এজন্য অবশ্য ভারতের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াই দায়ী। গলদ আছে সিস্টেমেও। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো নিয়ে মীনাক্ষী গাঙ্গুলি জানান, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, সেটা ভারত জানে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কনভেনশনের সদস্য হিসেবে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নিতে বলতে পারে দিল্লি। না নিলে সেটা হবে মানবাধিকার লঙ্ঘন। কারণ তারা সবাই নিজ ভিটামাটি থেকে উৎখাত হয়ে ভারতে এসেছে।

আরএসএসের নারী সদস্যদের প্রশিক্ষণ

অপরদিকে ভারতের ৭০তম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে নরেন্দ্র মোদি চতুর্থবার দিল্লির লালকেল্লার প্রাকার থেকে প্রথাগত ভাষণে বলেছেন, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান গুলি দিয়ে বা গালি দিয়ে হবে না। হবে সম্প্রীতি দিয়ে। এজন্য গড়তে হবে নব ভারত। কিন্তু ‘নব ভারতের সংকল্প’ বলতে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? সংখ্যাগুরু দলতন্ত্রের চাপে বিরোধীদের কণ্ঠরোধ?

কাশ্মীর ইস্যুতে শান্তির কথা বললেও সমলোচক এবং ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেস বরাবরই অভিযোগ করে এসেছে, মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভয়াবহ অবনতি হয়ে কাশ্মীরের শান্তি-শৃঙ্খলার।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে কাশ্মীর। দুই দেশই পুরো ভূখণ্ডটি দাবি করে। তবে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের বেশিরভাগ মানুষ হয় স্বাধীনতা চায়, না হয় পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চায়। তিন দশক ধরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে কাশ্মীরের বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী সংগঠন।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুসারে, চলতি বছরের এই পর্যন্ত কাশ্মীর সহিংসতায় অন্তত ১৩০ বিদ্রোহী ও ৩৯ সেনা নিহত হয়েছে। গত বছরের ৮ জুলাই কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিন নেতা বুরহান ওয়ানিকে ভারতীয় বাহিনী গুলি করে হত্যা করার পর থেকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে বেসামরিক লোকজনের অংশগ্রহণ বেড়েই চলেছে। তার মৃত্যুর পর কয়েক মাস ধরে গণবিক্ষোভে শতাধিক লোককে হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী। পেলেট গুলিতে অনেকেই অন্ধ হয়ে যায়। এতে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে কাশ্মীরের মানুষ।

গত বছর বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে কাশ্মীরে অভিযান শুরু করে ভারত সরকার। এতে কাশ্মীরিদের মাঝে বিক্ষোভ আরো বেড়েছে। ইতিহাসে এই প্রথম ওই অঞ্চলের স্কুলগামী মেয়েরাও রাস্তায় নেমে এসেছে। চলতি বছর কাশ্মীরের স্থানীয় নির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র সাত শতাংশ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, ভারতের হাতছাড়া হতে যাচ্ছে কাশ্মীর। বর্তমানে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন করে রেখে অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত।

ভারতের একমাত্র মুসলিমসংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর ২০১৪ সাল থেকে ভারতের প্রতি অনুগত দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক অপ্রিয় জোটের দ্বারা শাসিত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা কাশ্মীরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের বিরোধিতাকে আরও তীব্র করছে। ওয়ানির মৃত্যুর পর বিদ্রোহীদের সাথে প্রায় ১০০ জন কাশ্মীরি যুবক যোগ দিয়েছে। পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী থেকে অনেকেই অস্ত্র ছিনিয়ে নিতেও সক্ষম হয়েছে তারা।

গো নিউজ২৪/ আরএস

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর
বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত সহজ করতে চালু হচ্ছে অন অ্যারাইভাল ভিসা

বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত সহজ করতে চালু হচ্ছে অন অ্যারাইভাল ভিসা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও