আরব দেশে জন্ম হলে নামটা হতো, রজব তৈয়ব রিদওয়ান। অবশ্য তুরস্কে জন্ম নেয়ায় এই তুর্কি প্রেসিডেন্টের নাম হয়েছে, রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। সমর্থকরা তাকে ডাকেন ‘মিল্লিয়ে আদামি’ বা ‘জনগণের মানুষ’ বলে। প্রকৃতপক্ষে কতটা জনগণের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছেন তিনি- এমন প্রশ্নই ছিল তুর্কিদের কাছে।
ঠিক এক বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুর্কি সেনাবাহিনীর একদল বিপথগামী সদস্য যখন এরদোয়ান সরকারকে হটিয়ে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করছিল, তখন তার একটি ডাকেই রাজপথে ছুটে এসেছিল মানুষ। সেনাঅভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল তারা। নিজের জীবন দিতেও ভয় পায়নি এসব তুর্কি। গত বছরে ওই ঘটনায় মোট নিহত হয় ২৬০ জন মানুষ। আহত হয় ২ হাজার ১৯৬ জন। সেই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালন করছে তুরস্ক। এ নিয়ে আয়োজন করা হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তারা ছুটে এসেছিল এরদোয়ানের পক্ষে।
অনুষ্ঠানের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একজন ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসার কারণেই তারা ছুটে এসেছিলেন রাজপথে। এমনই একজন এরসিন কর্কমাজ। তুরস্কের পতাকায় সজ্জিত হয়ে আছেন ২৯ বছরের এই তুর্কি। সঙ্গে আছে তার দুই মেয়েও। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে এরসিন বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রেসিডেন্টকে অনেক ভালোবাসি। ইস্তাম্বুল বিজেতা সুলতান মেহমেদ’র পর তিনিই আমাদের সবচেয়ে ভালো শাসক।’ ১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপল বিজয় করেছিলেন উসমানীয় সুলতান মেহমেদ।
তবে এরদোয়ানের পশ্চিমা মিত্ররা মনে করেন ভিন্ন কথা। দিন দিন তিনি কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করেন তারা। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে তার শুদ্ধি অভিযান নিয়ে সতর্কতাও দিয়েছেন পশ্চিমা নেতারা। তুরস্কের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছানির্বাসিত আলেম ফেতুল্লাহ গুলেন ওই অভ্যুত্থান চেষ্টার মূলহোতা। যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন তিনি। গুলেনের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এক লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৫০ হাজার জনকে। এর মধ্যে রয়েছে, সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী এবং শিক্ষক। এরদোয়ানের ভাষায়, তুরস্ককে ‘ভাইরাসমুক্ত’ করা হচ্ছে।
এরদোয়ান সমর্থক ও অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সম্প্রতি দেশটির প্রধান বিরোধী দল সিএইচপিকে ১৫ দিনব্যাপী সমাবেশ করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। তারা রাজধানী আংকারা থেকে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত পদযাত্রা করেছেন। এতে কোনও বাধা দেয়া হয়নি। ইস্তাম্বুলের সমাবেশে তাদের ১৫ হাজার পুলিশ দিয়ে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। সুতরাং বিরোধীদের ওপর নিপীড়নের যে অভিযোগ, তা মোটেও ঠিক নয়।
তুরস্কের উপ-প্রধানমন্ত্রী মেহমেদ সিমসেক বলেন, ‘অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট সব বিষয় দেখার জন্য স্বাধীন কমিশন করা হয়েছে। যদি কোনও ভুল হয়ে যায়, তবে তা তারা খতিয়ে দেখবে। আমার ইতোমধ্যে কয়েক হাজার সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে তাদের চাকরিতে ফিরিয়ে দিয়েছি।’
রাস্তায় জড়ো হওয়া তুরস্কের আরও এক নাগরিক আদম চেঙ্কিয়া এরদোয়ান সম্পর্কে বলেন, ‘অনেকে তাকে স্বৈরশাসক আখ্যা দিতে চায়। কিন্তু আমরা যারা আগের শাসকদের দেখেছি তারা জানি, তিনি মোটেও তেমনটা নন।’ ৪২ বছরের আদম আরো বলেন, ‘এ কারণেই আমরা সবাই তাকে ভোট দেই। আমাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমরা এরদোয়ানের সঙ্গে আছি।’
এরদোয়ান এবং তার দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) জনপ্রিয়তার তিনটি প্রধান কারণের কথা জানান তার সমর্থকরা। প্রথম কারণটা সামাজিক। এরদোয়ানকে নিজেদেরই একজন মনে করে তুরস্কের জনগণ। দেশটির নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তরা প্রেসিডেন্টকে নিজেদের প্রতিনিধি বলেই মনে করে। আগের শাসকদের সময় এসব শ্রেণি ছিল নানাভাবে উপেক্ষিত।
একে পার্টির পতাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় জড়ো হওয়া ইসমাইল নামের একজন তুর্কি এই প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে বলেন, ‘ব্যাপারটি হচ্ছে, এরদোয়ানের আগের প্রেসিডেন্টরা জনগণকে মূল্য দিত না। কিন্তু এরদোয়ান সব সময় তাদের প্রতি মনোযোগী। এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। আমরা তাকে আমাদেরই একজন মনে করি।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক ইউরোপীয় গবেষণা সংস্থা ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশন্স’র তুর্কি গবেষক আসলি আয়দিন্তাবাস বলেন, পুরো একে পার্টির অবস্থানটাই হচ্ছে, তারা অভিজাতদের (এলিট) কাছ থেকে তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছেন। এলিটরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। তুরস্কের জনগণ এরদোয়ানকে একে পার্টির এই অবস্থানের মূর্তরূপ মনে করে। আগের শাসকদের সময়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল জনগণের বিরুদ্ধে। আর এখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণেরই প্রতিষ্ঠান।
এরদোয়ানের জনপ্রিয়তার পেছনে আছে ধর্মীয় কারণও। এরদোয়ানের ইসলামপন্থি একে পার্টি সব সময়ই তুর্কি সমাজের ধর্মানুসারী অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯২৩ সালে আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কেমাল আতাতুর্ক দেশটিতে সেক্যুলার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময়ে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ধর্মানুসারীরা। আতাতুর্ক ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কে মুসলিম নারীদের পর্দা নিষিদ্ধ করা হয়। এছাড়া তুরস্কে আজান এবং আরবি অক্ষরও নিষিদ্ধ করেন। দুই মেয়ে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে আসা এরসিন কর্কমাজ বলেন, ‘আমাদের জনগণ ছিল বিকৃত এবং বিভ্রান্ত। আল্লাহকে ধন্যবাদ যে আমরা একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারছি।’
এরদোয়ানের জনপ্রিয়তার পেছনে তৃতীয় কারণটি হচ্ছে তুরস্কের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে ভালো আছে তুর্কিরা। ২০০৩ সালে এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর থেকে অর্থনীতিতে অনেক এগিয়েছে তুরস্ক। ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অবকাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে এরদোয়ানের সময়ে। রাস্তা, সেতু, মেট্রো লাইনের উন্নয়ন ছাড়াও স্বাস্থ্যখাতেও এসেছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
সরকারি হাসপাতালেই সব ধরনের স্বাস্থসেবা পায় দরিদ্র তুর্কিরা। এর সবটুকু কৃতিত্বই এরদোয়ানকে দিতে চান আদম চেঙ্কিয়া। নিজের মায়ের কিডনি চিকিৎসাও সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে করাতে পেরেছেন তিনি। এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার আগে সেটা সম্ভব হয়নি। তখনও মাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি। এখন চেঙ্কিয়া তার মাকে সপ্তাহে তিনবার বিনা খরচেই করাতে পারেন ডায়ালাইসিস।
তিনি বলেন, ‘এরদোয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছেন। স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ, বৃদ্ধদের সেবায় এসেছে উন্নতি। মুদ্রাস্ফীতিও কমেছে। জনগণকে অনেক বেশি মূল্যায়ন করা হচ্ছে।’
‘রাইজ অব টার্কি’ (তুরস্কের উত্থান) নামক একটি বইয়ের লেখক সোনের সাগাপতাই মনে করেন, এরদোয়ান যদি কিছুটা কর্তৃত্বশালী হয়ে ওঠে তো হোক। জনগণও এটাকে সঠিক মনে করে। একে এক ধরনের কৌশল বলেই মনে করেন তিনি। সরকারের সাম্প্রতিক অভিযান সম্পর্কে সোনের বলেন, প্রশাসনে যারা হুমকিস্বরূপ তাদের সরিয়ে দেয়াই বিধিসম্মত। তার ভাষায়, ‘সব সময়ই এরদোয়ানের এমন কিছু বিরোধী ছিল, যারা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। তাই অভিযানকে ঠিকই মনে করে বেশিরভাগ তুর্কি।’
গণমাধ্যমের ওপর তুর্কি সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ইসমাইল বলেন, ‘অনেক সাংবাদিক যা করছে সেটা বিশ্বাসঘাতকতা। সাংবাদিকতার নামে তারা যা ইচ্ছে তাই করছে। এক ধরনের সাংবাদিক আছে যারা দেশকে সহায়তা করছে। আরেক ধরনের সাংবাদিক আছে যারা বিশ্বাসঘাতক।’
চলতি সপ্তাহে বিবিসির হার্ডটক অনুষ্ঠানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জানান, বর্তমানে মাত্র দুইজন প্রকৃত সাংবাদিক জেলে রয়েছেন। তিনি বলেন, বাকি যাদের সাংবাদিক বলা হচ্ছে, তারা সাংবাদিকতার ছদ্মবেশে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তারা মানবাধিকার সংস্থার কর্মী এবং সাংবাদিক পরিচয়ে তুরস্কবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমবার ১৯৬০ সালে সেনাঅভ্যুত্থান হয় তুরস্কে। বন্দি করা হয় প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টকে। দ্বিতীয়বার ১৯৭১ সালে ক্ষমতা নেয় সেনাবাহিনী। ১৯৮০ সালে আবারও অভ্যুত্থান হয় তুরস্কে। সর্বশেষ হয় ১৯৯৭ সালে। নিষিদ্ধ করা হয় প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন আরবাকানের ওয়েলফেয়ার পার্টি।
ওই দল থেকে বেরিয়ে এসেই জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি করেন তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ২০০২ সালে ক্ষমতায় আসে দলটি। এরপর থেকে কোনও নির্বাচনে হারেনি এরদোয়ানের দল। তুরস্কও পৌঁছেছে স্থিতিশীল অবস্থায়। অর্থনীতি এবং অবকাঠামোতে এসেছে নজিরবিহীন উন্নয়ন। অনেকে একে বলেন, ‘অর্থনীতি ও উন্নয়নের এরদোয়ান মডেল’।
এরদোয়ান কি শিগগিরই তার জনপ্রিয়তা হারাতে পারেন? এটা আপাতত প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। যতক্ষণ তুরস্কের অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকবে এবং বিরোধী দল একটা যোগ্য নেতৃত্ব না পাবে ততক্ষণ এটা অসম্ভবই। তবে দেশ দুভাগে ভাগ হয়ে যাক এটাও চান না এরদোয়ানপন্থিরা। তুরস্কের বিরোধী দলও অভ্যুত্থান চেষ্টার বিরোধীতা করেছে। মিলেমিশেই দেশকে এগিয়ে নিতে চান তারা।
গো নিউজ২৪/ আরএস