ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে কেন হেরে গিয়েছিল ভারত?


গো নিউজ২৪ | আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ১৯, ২০১৭, ১২:৩৯ পিএম
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে কেন হেরে গিয়েছিল ভারত?

সম্প্রতি চীন-ভুটানের মধ্যবর্তী ডোকলাম অঞ্চল নিয়ে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা শুরু হয়েছে চীনের। গত জুনে ওই অঞ্চলে চীন একটি সড়ক নির্মাণ শুরু করলে বিরোধ শুরু হয় ভুটানের সঙ্গে। থিম্ফুর অনুরোধে সেখানে সেনা পাঠায় ভারত সরকার। রাস্তা নির্মাণ নিয়ে চীনকে সতর্কতাও দেয় তারা। চীন, ভারত ও ভুটানের মধ্যকার ত্রিদেশীয় ডোকালাম সীমান্ত নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ আছে পরমাণু শক্তিধর এই দুই দেশের মধ্যে। ৩০ বছর ধরে এ নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে আছে তারা। চীনারা ডোকলাম সীমান্তকে ‘ডোংলাং’ নামে আখ্যায়িত করে এবং নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে।

এদিকে ডোকালাম অঞ্চলকে কেন্দ্র করে চলমান উত্তেজনায় বারবার ভারতকে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে চীন। দেশটির গণমাধ্যম থেকে এ পর্যন্ত বহুবার বলা হয়েছে, ওই যুদ্ধ থেকে ভারত যাতে শিক্ষা নেয়। চীন-ভারত সামরিক উত্তেজনার প্রসঙ্গ এলেই উঠে আসে ৬২’র যুদ্ধের কথা। ওই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল ভারত। এজন্য চীনের গণমাধ্যমগুলো ক্রমাগত তুলে ধরছে সেই সময়ের কথা।

অবশ্য ভারত বরাবরই দাবি করে আসছে, ১৯৬২ সালের অবস্থা থেকে অনেক দূর এগিয়েছে তারা। তবে ঐতিহাসিক তথ্য এটাই যে ওই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত ভারতকে সহায়তা করেছিল। এছাড়া তার পাশে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যও। তখনকার সময়ের বড় বড় পরাশক্তিগুলো ছিল ভারতের পক্ষে। সেই সময়ে মার্কিন শক্তির কাছে চীন কিছুই ছিল না। তবুও ওই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের সমর্থন সত্ত্বেও হেরে গিয়েছিল ভারত। কিন্তু কেন?

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকা, কানাডা ও লাতিন আমেরিকা স্টাডি সেন্টারের অধ্যাপক চিন্তামণি মহাপাত্র বলেন, ‘যখন চীন ভারতের ওপরে হামলা করে, সেই সময় কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র সংকট নিয়ে ব্যস্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছিল, ফলে পারমাণবিক যুদ্ধের একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। পুরো পৃথিবীই সেই সময় একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।’

এই গবেষক আরো বলেন, ‘কমিউনিস্ট রাষ্ট্র চীন যখন ভারতের ওপর হামলা করলো, একই সময় আরেকটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিউবাতে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠালো। যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাহায্য করতে পুরো তৈরি ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে বারবার চিঠি পাঠিয়ে সাহায্য চাইছিলেন। নেহরু এমনও বলেছিলেন যে তিনি যুদ্ধবিমান কিনতেও আগ্রহী।’

নেহরুর চিঠি পেয়েই কেনেডি সাহায্যের সিদ্ধান্ত নেন। যদিও এটাও বলা হয় যে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ওপরে পাকিস্তানের চাপ ছিল, যাতে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে সাহায্য না করা হয়। তার মানে কি এটাই যে প্রেসিডেন্ট কেনেডি এই ঘটনায় একা হয়ে গিয়েছিলেন?

অধ্যাপক মহাপাত্র বলেন, ‘না। ব্যাপারটা সে রকম হয় নি। তিনি একা পড়ে যাননি, কিন্তু পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ দিচ্ছিল। শুরুর দিকে নেহরু তো প্রেসিডেন্ট কেনেডির সঙ্গে যুদ্ধের সরঞ্জাম কেনার কথা বলছিলেন। কিন্তু তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চীন এমন একটা ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল, ফলে নেহরু ওয়াশিংটনে একটা বিপদ সঙ্কেত পাঠাতে বাধ্য হলেন। চীন পুরোপুরি সমতল এলাকায় চলে এসেছিল।’

নেহরুর ওই বিপদ বার্তা পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে যখন মার্কিন সাহায্য এসে পৌঁছল, ততক্ষণে চীন নিজ থেকেই কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল। তাই যুক্তরাষ্ট্রের আর বিশেষ কিছু করার ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিতে কেন দেরি করলো মার্কিন প্রশাসন।

যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি সেন্টারের সাবেক সিনিয়র ফেলো অনিল আঠালে ২০১২ সালে রেডিফ ডট কমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ঘটনাক্রম সেই সময়ে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র সংকট চলছিল। বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন- উভয় পক্ষই কিউবায় হাজির। ওই পরিস্থিতিতে বিশ্ব গণমাধ্যম ভারত-চীন যুদ্ধটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘কিন্তু এখন যদি আমরা পিছন ফিরে তাকাই তাহলে বুঝতে পারব যে কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র সংকটটা অ্যাকাডেমিক রিসার্চের দিক থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারত চীন-যুদ্ধের প্রভাব অনেক বেশি ছিল সেই সময়।’

অধ্যাপক মহাপাত্র বলেন, ‘১৫ দিন যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যখন সাহায্য নিয়ে এলো, ততদিনে চীন পিছিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভয়ও ছিল যে চীন যখন ভারতে হামলা করছে, সেই সময়ে পাকিস্তানও যদি ভারতে হামলা করে বসে। তাই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল, চীন কমিউনিস্ট দেশ, নিজেদের এলাকা বাড়ানোর জন্য চীন তাদের দেশও দখল করে নিতে পারে। এই যুক্তিটা অবশ্য পাকিস্তান মানেনি। তখনই তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কাশ্মীরের ব্যাপারে মার্কিন সমর্থন দাবি করে বসে।’

যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু

কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সে সময় কিউবা সংকট বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফ্লোরিডা থেকে কিউবার দূরত্ব মাত্র ৮৯ কিলোমিটার। আর সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের পুরো নজর তখন সেদিকেই ছিল। আর তখন তাকে সাহায্য করার মতো কোনো দেশও ছিল না। নেহরু তখন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতকে সামিল করেছিলেন।

ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন স্টাডিজ সেন্টারের অধ্যাপক হেমন্ত আদলাখা বলেন, ‘নেহরুর ওই নীতিতে একটা বড় ধাক্কা লেগেছিল, কারণ জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর কেউই ভারতের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি তখন।’

তিনি আরো বলেন, ‘যদিও যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য পাঠানোর আগেই চীন নিজের থেকেই কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে না এলে চীন আরো অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়তো।’

যদিও অধ্যাপক মহাপাত্র মনে করেন, নেহরুও নিজের জোটনিরপেক্ষ নীতির কারণেই প্রথমে মার্কিন সাহায্য চাইতে কিছুটা সংকোচ করেছিলেন। কিন্তু চীন যখন আসাম পর্যন্ত পৌঁছে গেল, তখন নেহরুর সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আন্তর্জাতিক নীতির তুলনায় জাতীয় সুরক্ষাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

চীন কি তাহলে জেনে বুঝেই ভারতের ওপর হামলার জন্য ওই সময়টা বেছে নিয়েছিল? যে সময় কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র সংকট চলছে, সেই সময়টাকেই কেন চীন ভারতে হামলার জন্য বেছে নিয়েছিল- এই প্রশ্নে জবাবে অধ্যাপক মহাপাত্র বলেন, ‘চীন আর সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটোই যেহেতু কমিউনিস্ট দেশ, সম্ভবত সেই কারণেই হামলার সময়টা বেছে ছিল চীন।’

তিনি আরো বলেন, ‘ভারতের ওপর হামলার দুই বছর পর ১৯৬৪ সালে চীন প্রথম পরীক্ষামূলক পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই যে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় থেকে ভারত এখন অনেক এগিয়েছে, আর কিউবাতে এখন মিসাইল সংকটও নেই।’ তবে এ নিয়ে আছে দ্বিমতও। কারণ ভারত সেই সময়ের চেয়ে অনেকখানি এগোলেও, পিছিয়ে নেই চীনও। সামরিক শক্তি এবং অর্থনীতিতে নজিরবিহীন উত্থান ঘটেছে চীনের। তাছাড়া ৬২ সালে যুক্তরাষ্ট্র কিউবা সংকট নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও যুক্তরাজ্য তার পক্ষেই ছিল। ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নও। কিন্তু চীনের পক্ষে পাকিস্তান ছাড়া কেউ ছিল না।

আসামের নারী সেনারা

আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে সে ধরনের কোনো যুদ্ধ বাঁধলে কোনো পরাশক্তি ভারতকে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসবে কি না- এ নিয়েও আছে সংশয়। বর্তমানে চীনের যে অবস্থান এবং বিশ্ব রাজনীতিতে যে পরিস্থিতি চলছে তাতে চীনাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ নিয়েই বড় ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে মার্কিন প্রশাসনকে।

প্রসঙ্গত, সীমানা নিয়ে বিরোধ থেকেই ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। চীন তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও আকসাই চীনকে নিজের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলে দাবী করে। এভাবে যে সীমান্ত সমস্যার শুরু হয় তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সূচনা করে। যুদ্ধে ভারত একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। চীন আকসাই চীন দখলে রাখে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ ফিরিয়ে দেয়। ওই যুদ্ধের পর থেকেই ভারতের শান্তিবাদী পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আসে।

‘৬২ সালের যুদ্ধে চীনা নেতা মাও সে তুং ‘এক ঢিলে অনেক পাখি’ মেরেছিলেন। এর ফলে তার অনেক রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ হয়: ভারতের সঙ্গে ভূখণ্ড নিয়ে টানাহেচড়া বন্ধ হয়, তার আমলে সৃষ্ট বিপজ্জনক অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি থেকে চীনাদের মনোযোগ সরে যায়, এটি ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণি ও নেহেরুর বিরক্তিকর অভ্যন্তরীণ নীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষতিসাধন করে, চীন-সোভিয়েত আদর্শিক বিরোধে সোভিয়েতদের অবস্থান দুর্বল করে এবং তিব্বত ও তাইওয়ানকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল প্রতিহত করে।

গো নিউজ২৪/ আরএস

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর
বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত সহজ করতে চালু হচ্ছে অন অ্যারাইভাল ভিসা

বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত সহজ করতে চালু হচ্ছে অন অ্যারাইভাল ভিসা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও