ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কাতারের ওপর অবরোধ দিয়ে কতটা সফল সৌদি আরব?


গো নিউজ২৪ | আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০১৭, ০৪:৫৫ পিএম আপডেট: জুলাই ২১, ২০১৭, ১০:৫৫ এএম
কাতারের ওপর অবরোধ দিয়ে কতটা সফল সৌদি আরব?

গত জুনের শুরুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ছিল কাতারের ওপর সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের অবরোধ এবং দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার খবর। অল্প সময়ের জন্য হলেও এতে ব্যাপক সমস্যায় পড়েছিল দোহা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় দেশটির অর্থনীতি। আর সেই চাপকে কাজে লাগিয়ে কাতারকে শর্তের বেড়াজালে আটকে ফেলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ওই দুই দেশের নেতৃত্বে কাতারকে কোণঠাসা করার সব আয়োজনই শেষ হয়েছিল। কিন্তু মাস দেড়েক পর দেখা যাচ্ছে, সেই অবরোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে কাতার।

গত ২৩ মে হ্যাকাররা কাতারের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম কিউএনএ’র ওয়েবসাইটে একটি ভুয়া প্রতিবেদন যুক্ত করে দেয়। এতে দেখা যায়, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি ইরান, হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইসরায়েলকে সমর্থন জানিয়ে মন্তব্য করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় টিকে থাকবেন কি না- তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। অথচ এটি ছিল সর্বৈব মিথ্যা! আর এ থেকেই সংকটের শুরু।

ওই ঘটনার পর গত ৫ জুন ‘সন্ত্রাসবাদে সমর্থন’ দেয়ার অভিযোগ তুলে কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দেয় সৌদি আরব এবং তার মিত্র মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন। পরে এই তালিকায় যুক্ত হয় মালদ্বীপ এবং লিবিয়া ও ইয়েমেনের পশ্চিমা সমর্থিত সরকার। সড়কপথ, নৌ-পথ ও আকাশ পথেও কাতারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে আরব দেশগুলো। অবশ্য ওই অভিযোগকে শুরু থেকেই ‘ভিত্তিহীন’ বলে প্রত্যাখ্যান করে আসছে কাতারি প্রশাসন।

ওই সময় সৌদি আরবসহ সাতটি দেশ কাতারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে। সম্পর্ক ছিন্নকারী আরব রাষ্ট্রগুলো ২২ জুন ১৩ দফা দাবির একটি তালিকা দেয় দোহাকে। এতে আল জাজিরা টেলিভিশন বন্ধ এবং ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করাসহ আরও কিছু দাবি পূরণের কথা বলা হয়। ওইসব দাবির তালিকায় আরও আছে: কাতারে নির্মিত তুরস্কের সেনাঘাঁটি বন্ধ করা এবং যেসব ব্যক্তিকে তাদের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেয়া হয়েছে, তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়া। অবস্থা এমন ছিল, যেন অবাধ্য সন্তানকে পিটিয়ে শায়েস্তা করা হচ্ছে!

বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সৌদি ও আরব আমিরাতের নেতৃত্বে আরোপ করা অবরোধ দোহাকে কাবু করতে পারছে না। যে উদ্দেশ্যে এই অবরোধ আরোপ করা হয়েছিল, সেটিও থাকছে নাগালের বাইরে। কাতারকে আঞ্চলিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার বদলে এই অবরোধ উল্টো তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছে। ওমান ও কুয়েতও অবরোধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি। কাতারের বন্দর ও বিমানবন্দরে খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের সরবরাহে এখনো উল্লেখযোগ্য ঘাটতির সৃষ্টি হয়নি। হোয়াইট হাউস এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। তবে তাতে কাতারের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকেরা বরং সৌদি ও আমিরাতের দাবির দিকে কম পাত্তা দিয়ে, জোর দিচ্ছে কাতারের সঙ্গে মিটমাট ও আপসের প্রতি।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মার্ক লিঞ্চ বলেন, ‘ইয়েমেনে সর্বনাশা এক যুদ্ধের পর সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সাফল্যের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু তা করতে গিয়ে কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। একটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে বিকল্প পরিকল্পনা লাগে। আর সেটি তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। বিশেষ করে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসি থেকে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করে সফল হতে চেয়েছিল বিরোধী চারটি দেশ। কিন্তু তা কাজে দেয়নি। প্রতিবেশীর ক্ষতি করার ব্যাপারে নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কেও তাদের ধারণা ভুল ছিল।’

চলতি সপ্তাহে ওয়াশিংটন পোস্টে অবরোধকারীদের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে বলা হয়েছে, গত মে মাসের শেষের দিকে কাতারের সরকারি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হ্যাক করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। দোহা উচ্চকণ্ঠে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। কিন্তু তারপরও অটল থাকে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। কাতারের সংবাদমাধ্যমকে প্রথমে নিষিদ্ধ করে এই দেশগুলো। পরে দোহার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে একঘরে করে ফেলে।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতে, নতুন করে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের হ্যাকিংয়ের সঙ্গে আরব আমিরাত জড়িত বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত ২৩ মে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা হ্যাকিংয়ের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। আর তার পরদিনই কাতার সরকারের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যম অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয়। তবে হ্যাকিংয়ের ঘটনা আরব আমিরাত নিজে করেছে নাকি অন্য কোনো ভাড়াটে সংস্থাকে দিয়ে করিয়েছে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চিত করতে পারেনি।

অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ আল-ওতাইবা এসব দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘হ্যাকিংয়ের যে ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, তাতে আমার দেশের কোনো ভূমিকা নেই। কাতারের আচরণে সমস্যা আছে। তারা তালেবান থেকে শুরু করে হামাস পর্যন্ত সবাইকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কাতার মৌলবাদে উৎসাহ দিচ্ছে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোকে অস্থিতিশীল করছে।’

কাতার নিয়ে গুজব ও মিথ্যা সংবাদ ছড়ানোর নজির আগেও পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালে একটি খবর রটেছিল যে, লন্ডনে কাতারের মালিকানাধীন একটি দোকানে সৌদি ও আমিরাতের নাগরিকদের ঢোকা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সেটি ছিল মিথ্যা।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, কাতারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিরোধের সূত্র ধরেই বর্তমান টানাপোড়েনের সূচনা। কাতারের ধনী ব্যক্তিরা যেভাবে আঞ্চলিক বিরোধ ও রাজনীতিতে ভূমিকা রাখছেন, তা প্রতিবেশী দেশগুলোর পছন্দ হচ্ছে না। বিশেষ করে সিরিয়া ও লিবিয়া ইস্যুতে কাতারের ভূমিকা ভালো চোখে দেখেনি কোনো প্রতিবেশী। আর তাই দেশটির প্রধান সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে পুরোপুরি বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে রিয়াদ ও আবুধাবি।

নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ডেকলান ওয়ালশ বলেন, ‘আঞ্চলিক রাজনীতি ও সংঘাতে একটি নিরপেক্ষ মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কাতার। বিবদমান সব পক্ষই দোহার সঙ্গে আলোচনা করত। ফলে ধীরে ধীরে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়নক হয়ে উঠেছিল দোহা। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ভিয়েনা যে ভূমিকা রাখত, দোহা ছিল ঠিক তেমনই। আর এগুলোই আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে।’

এছাড়া আরব দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে, কাতার ইসলামপন্থিদের সহায়তার দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ দেখিয়ে আসছে দেশগুলো। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে এই দলটি বর্তমানে নিষিদ্ধ। ব্রাদারহুড রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। তাদের এই আদর্শকে হুমকি হিসেবে দেখে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো।

২০১২ সালে মিসরের ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ব্রাদারহুড নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলেও ২০১৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। এরপর থেকে ব্রাদারহুড সমর্থকদের ওপর চালানো হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর নির্যাতন। এতে সমর্থন দেয় সৌদি সরকার।

সংকট সমাধানে এখন কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কাতার ও এর ওপর অবরোধ আরোপ করা সব দেশই যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। সুতরাং ‘শ্যাম রাখি, না কূল রাখি’ অবস্থায় পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলাসন এরই মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে কুয়েত, কাতার ও সৌদি আরবের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে কাতারের সঙ্গে যেন অন্যান্য দেশগুলো আপসে আসে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি আছে কাতারে। তাই কাতারকে বাদ দিয়ে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিয়ে কথা বলতে বেশি আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। তারা চাইছে বিরোধ যেন ধামাচাপা পড়ে। কিন্তু এখনো সেই কাজে সাফল্য আসেনি।

গো নিউজ২৪/ আরএস

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর
বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত সহজ করতে চালু হচ্ছে অন অ্যারাইভাল ভিসা

বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত সহজ করতে চালু হচ্ছে অন অ্যারাইভাল ভিসা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও