ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট


গো নিউজ২৪ | নিয়ন মতিয়ুল প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২১, ০২:৫৬ পিএম আপডেট: জানুয়ারি ১১, ২০২১, ০৮:৫৬ এএম
প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

কিছুদিন আগে দেশের শীর্ষ সারির এক সাংবাদিক ‘সাংবাদিকতার সর্বনাশ’ শিরোনামে এক ফেসবুক পোস্টে গণমাধ্যমকর্মীদের বর্তমান কর্মতৎপরতা নিয়ে চরম হতাশা প্রকাশ করে কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছেন। সাংবাদিকতা আর সংবাদকর্মীদের অতীত ও বর্তমানের কাজের ধারা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছেন। বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতার যে ‘সর্বনাশ’ ঘটে গেছে তা-ই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সেখানে।

তরুণদের জন্য সাংবাদিকতার পথ প্রদর্শকখ্যাত শীর্ষ সেই সাংবাদিকের ফেসবুক পোস্টটি পড়েছেন অনেকেই। আলোচনার পাশাপাশি কেউ কেউ গভীরভাবে বিশ্লেষণেরও চেষ্টা করেছেন। তবে শুধু যে ‘সাংবাদিকতার সর্বনাশ’ হয়েছে তাই নয়, ব্যবস্থাপনাসহ ভেতর-বাইরের নানামুখী সংকটও গণমাধ্যমের (বিশেষত প্রিন্টমিডিয়া) গতিকে পেছনে টানছে। হতাশাজনক এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা’ বিভাগের শিক্ষার্থীরা। যাদের অনেকেই অধ্যায়নরত অবস্থাতেই গণমাধ্যমে হাতে-কলমে চর্চা শুরু করেছেন। কেউ কেউ আবার উচ্চডিগ্রি নিয়ে কর্মসংস্থান খুঁজছেন।

মূলত গণমাধ্যমের এই ‘সর্বনাশা’ পরিস্থিতির ‘ফল’ ভোগ করতে হচ্ছে সক্রিয় প্রতিটি সংবাদকর্মীকেই। এ মাধ্যমের একজন কর্মী হিসেবে নবাগত বা তরুণদের জন্য নিশ্চিতভাবেই কিছু দায় থেকে যায়। পেশাগত কারণে অনেক তরুণের প্রত্যাশা-প্রাপ্তি আর অভিজ্ঞতার গল্প ভাগাভাগি করার সুযোগ হয়েছে। চলমান সংকটে তাদের চোখে মুখে যে হতাশার করুণ ছবি দেখা যাচ্ছে তা প্রশমনে আপাত কোনো সুখবর নেই কারো কাছে।

তবে এটা বলাই যায়, অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আমাদের সামনে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিলেও প্রিন্টমিডিয়ার আবেদন এখনও শেষ হয়নি। বরং অনলাইন বাস্তবতাকে সামনে রেখে নতুন করে ভাবার অনেক সুযোগ রয়েছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে উন্মোচিত হতে পারে নতুন এক দিগন্ত। সেজন্য বেসরকারি উদ্যোক্তা আর পরিচালক, নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে হবে। ভেতরের সংকট আর প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে যুগপোযোগী ও নিত্যনতুন সৃজনশীল কর্মপরিকল্পনার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

অবশ্য এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, বেসরকারিভাবে পরিচালিত প্রিন্টমিডিয়ার সংকটকে আমরা যেভাবে বর্ণনা করি তাতে মূলত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা বৈশ্বিক বিষয়টির প্রতিই বেশি ফোকাস করা হয়। বেশি বেশি আঙ্গুল তোলা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দিকে। অথচ ভেতরের সংকট আর প্রতিবন্ধকতা যে দিন দিন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে সেটা আলোচনায় উঠে আসে না।

যদিও অভ্যন্তরীণ এসব সংকটকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেই সঙ্গে এসব সমস্যা উপলব্ধি, বিশ্লেষণ এখন সময়ের দাবি। আর বিষয়গুলো মুক্ত আলোচনায় উঠে এলে তরুণ সংবাদকর্মীদের জন্য বাস্তবতা উপলব্ধি সহজ হবে। বিদ্যমান সংকটকে গভীরভাবে উপলব্ধি করে তা সমাধানে নতুন করে আশাবাদী হয়ে ওঠাও সম্ভব। তরুণদের ভাবনার জগতকে প্রসারিত করতে এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারি-

সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি: ব্রিটিশ শাসনের দুশ’ বছরের ইতিহাস না টেনে শুধু পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকের স্বাধিকার আর স্বাধীনতা আন্দোলনের পূর্বাপর বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে ভূমিকা রেখেছে তা কিন্তু অবিস্মরণীয়। আবার স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। বলা যায়, সেটা ছিল এক স্বর্ণালী অধ্যায়। তবে একবিংশ শতাব্দিতে এসে বিজ্ঞান আর যোগাযোগপ্রযুক্তির কল্যাণে গোটা বিশ্বব্যবস্থাই বিস্ময়করভাবে বদলে গেছে। বদল এসেছে গণমাধ্যমের সনাতনী ধারাতেও।

আর বিশ্বব্যাপী এই পরিবর্তনের ধারার সঙ্গে সঙ্গে সোনালি অতীতের চেয়ে আমাদের এখন বর্তমান বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাই অনিবার্য। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বিশ শতকের দৃষ্টিভঙ্গিতে একবিংশ শতকের নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সক্ষমতা অর্জন। দুই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিগত দূরত্ব মোচন। তবে এর সঙ্গে অবশ্যই মানতে হবে, যে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রত্যাশা আর দর্শন ষাটের দশকে গণমাধ্যমের কর্মপরিকল্পনার ভিত তৈরি করেছে তার প্রাসঙ্গিকতা কিন্তু নতুন শতাব্দীতে আর নেই।

বদলে যাওয়া রাজনীতি, সমাজ আর রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে নতুন আশা আর সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা কিংবা তার জন্য দিকনির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের দায় এখন সবচেয়ে বড়। তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, দু’একটি ছাড়া গণমাধমের (প্রিন্ট মিডিয়া) বেশিরভাগ উদ্যোক্তা, পরিচালক কিংবা নীতিনির্ধারক সোনালি অতীতের মাপকাঠিতে এখনও নিজেদের মূল্যায়ন করছেন। তারা ফেলে আসা সময়ের মধ্যেই সংকট উত্তরণের পথ খুঁজছেন। নতুন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বদলে যাওয়া প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া কিংবা যৌক্তিকবোধসম্পন্ন সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

ব্রিটিশ ব্যবস্থাপনা: শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে চলা ঔপনিবেশিক আইন, শাসন আর প্রশাসনিক পদ্ধতি আমাদের মনস্তত্বে যে ছাপ ফেলেছে তা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি আজও। মানসিকতার গহীন গোপনে বহমান (জিনের ভেতরে) হীনমন্যতাবোধ গণমাধ্যমের পরিচালক আর কর্মীদের মধ্যে অনেকক্ষেত্রে ‘প্রভূ-ভৃত্যের’ সম্পর্ক তৈরি করেছে। বুদ্ধিবৃত্তিক আর উদারতার বদলে অবিশ্বাস আর নিপীড়নমূলক পদ্ধতিই দেখা যায় গণমাধ্যমের কার্যালয়গুলোর ব্যবস্থাপনায়। থিম বা স্লোগান হিসেবে ‘অসংকোচ প্রকাশ...’, ‘সত্যের সন্ধান...’, ‘যা কিছু ভালো...’ বা ‘মুক্তপ্রাণের...’ কথা বলা হলেও তার পক্ষে কোনো পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ খুব কম। বাস্তবতা এতটাই ভিন্ন, যা তরুণ সংবাদকর্মীদের বিস্ময় জাগাতে পারে।

বদলে যাওয়া বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্মীদের দক্ষতা কিংবা সৃজনশীলতা বাড়ানোর পরিবেশ সৃষ্টির বাধ্যবাধকতার কোনো তাগিদ বা তাড়নাও নেই। বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনার কারণে ব্যক্তিতুষ্টি বা তোষামোদের অবারিত সুযোগ তৈরি হয়েছে গণমাধ্যমে। নীতিনির্ধারক কিংবা পরিচালক পর্যায়ের ব্যক্তিদের একান্ত রুচিবোধ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর খেয়ালিপনার নজির দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে। যা গোটা টিমওয়ার্ক ব্যবস্থাপনাকে অকার্যকর আর বিভাজিত করছে। যোগ্যরা আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে। বিপরীতে অদক্ষদের উপরে ওঠার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। টিকে থাকার জন্য তৈরি হচ্ছে আন্তঃদল, উপদল আর অন্তর্দ্বন্দ্ব। এসব জটিল ব্যবস্থাপনার কারণে দিন দিন সৃজনশীলতা হারাচ্ছে বেশিরভাগ গণমাধ্যম। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করে গণমাধ্যমে তরুণ সংবাদকর্মীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সত্যিই বড় চ্যালেঞ্জ।

দলদাসত্ব: স্বাধীনতার পূর্বাপর রাষ্ট্র আর সমাজ জীবনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখা গণমাধ্যমের মূল চালিকা শক্তিই ছিল রাজনৈতিক চেতনা-আদর্শ। তবে শতাব্দি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনসহ নতুন প্রজন্মের আশা আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সুশাসন, গণতন্ত্র আর বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থানই এখন গণমাধ্যমের মূল লক্ষ্য। তবে স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে রাজনৈতিক দল আর সরকারকে গুলিয়ে ফেলার কারণে ইতোমধ্যে মূল লক্ষ্য থেকে সরে গেছে বেশিরভাগ গণমাধ্যম। দিকনির্দেশকের ভূমিকার বদলে হয়ে উঠেছে ব্যক্তি বা মহল বিশেষের রক্ষাকবচ কিংবা রাজনৈতিক অভিলাসের ‘টুলস’। গণমাধ্যমের বেশিরভাগ উদ্যোক্তা, পরিচালক কিংবা নীতিনির্ধারকের রাজনৈতিক পরিচয় যেমন প্রকাশ্য আলোচনায় আসছে তেমনি পরিবেশিত সংবাদ বা তথ্যের রাজনীতিকরণের প্রশ্নও তোলা হচ্ছে।

কোন গণমাধ্যম কোন দলের ‘সেবাদাস’ হয়ে পড়েছে তা (ওপেনসিক্রেট) সহজেই চিনতে বা জানতে পারছে জনগণ। অতিরাজনৈতিকবোধ কিংবা তোষণের কারণে গণমাধ্যমের সর্বজনীন ভূমিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে তথ্য অধিকারসহ জনগণের কাছে দল ও সরকারের জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা হয়ে পড়েছে গৌণ। সংবাদকে পণ্য আর পাঠককে ক্রেতা হিসেবে ধরে নিয়ে গণমাধ্যমের যে ‘বিজনেস মডেল’ তৈরি হওয়ার কথা- সেটা আর হচ্ছে না। যদিও এসব কারণে মৌলিক চরিত্র খুইয়ে কিছু গণমাধ্যম পাঠকের কাছে অজনপ্রিয় হয়ে উঠলেও ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্যে বহাল তবিয়তে থাকছে। যে কারণে সমস্যার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারছেন না কেউ-ই। বরং প্রণোদনামুখী হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আর এমন পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠনগুলোতে যেমন ভিড় বাড়ছে, তেমনি গুণ-দক্ষতার চেয়ে সরকারসমর্থক বলিষ্ঠ নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে চলেছে। যাতে প্রকৃত পরিস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে গভীর সংকটের বৃত্তেই আটকে থাকছে গণমাধ্যমের নতুন দিগন্ত।

গদবাঁধা-ছকবাঁধা: প্রাচীনকালের সপ্তম আশ্চর্য সেই পিড়ামিডের ‘উল্টো-সিদে’ রীতিতেই আটকে আছে গণমাধ্যমের লিখন-সম্পাদনশৈলী। অনুকরণ আর অনুসরণের ছক ভেঙে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের কোনো উদ্যম বা তাগিদ নেই। সনাতনী পদ্ধতির অভ্যাসের দাস হয়ে পড়া ‘প্রবীণকর্মীদের’ দিয়েই চলছে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা। যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে সৃজনশীলতা কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রতিবেদন পরিকল্পনা আর তা তৈরিতে গদবাঁধা পদ্ধতির বিকল্প নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। থাকলেও তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের ‘সংবাদ ভাবনা’ বিগত শতকের ঐতিহ্যের ‘মায়াতেই’ আটকে আছে। দু’একটি ছাড়া গণমাধ্যমগুলো ‘রাজপ্রাসাদ’ কেন্দ্রিক ‘রাজার ফরমান’ প্রকাশের কাজটিই করছে। ঐতিহ্যবাহী অনেক গণমাধ্যম ‘রাজতান্ত্রিক ও অভিজাত সাংবাদিকতার’ বৃত্তেই আটকে থাকছে। গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নতুন দিগন্তের সন্ধান দিতে সরকারি কিছু সংস্থার কর্মতৎপরতা চোখে পড়লেও তা আমলাতন্ত্র আর সনাতনী ছকেই সীমাবদ্ধ। কাগজে-কলমে ‘জন-গণ’ বলা হলেও দিনশেষে তা রাজকণ্ঠ হয়েই থাকছে।

অনলাইনকে উপেক্ষা: গেল দু’দশকের ব্যবধানে অনলাইন সংবাদমাধ্যম উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও বিপ্লব ঘটিয়েছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের সুবাদে যেমন বিস্তৃতি বাড়ছে তেমনি দ্রুত জনপ্রিয়ও হয়ে উঠছে। প্রায় শতভাগ তরুণ-তরুণীই এখন অনলাইনে খবর পড়ছেন। কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা মূলধারার গণমাধ্যমকে যা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। অথচ ইন্টারনেটভিত্তিক এই সংবাদ মাধ্যমকে সহজভাবে নিতে পারছেন না প্রিন্টমিডিয়ার বেশিরভাগ নীতিনির্ধারক ও পরিচালক। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে এক ধরনের উন্নাসিকতা কাজ করছে। যদিও অনেকের দাবি, আগামীতে অনলাইন গণমাধ্যমই মূলধারা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাবে।

এমন এক বাস্তবতায় অনলাইন সংবাদমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রিন্টমিডিয়াকে ঢেলে সাজিয়ে সামনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তেমন পরিকল্পনা কিংবা তোড়জোড় চোখে পড়ছে না। নামেমাত্র অনলাইন ভার্সন করেই তাল মেলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যেখানে নেই সৃজনশীলতা কিংবা আধুনিক ব্যবস্থাপনা। আর সংবাদ ব্যবস্থাপকদের ভেতরে এক ধরনের সূক্ষ্ম উদাসীনতার কারণে প্রিন্টমিডিয়া পাঠক হারানোসহ নানামুখী সংকটে দিন দিনই পিছিয়ে পড়ছে। অথচ অনলাইনের বাস্তবতাকে মাথায় রেখে প্রিন্টমিডিয়ার সংবাদ ভাবনাকে আরো সম্প্রসারিত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সংবাদ ব্যবস্থাপনা ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে আরো গভীরভাবে ভাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অথচ আশ্চর্য হলেও সত্য, সে ধরনের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে অনলাইনভিত্তিক সংবাদের ওপরেই ধীরে ধীরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বেশিরভাগ প্রিন্টমিডিয়া।

উপেক্ষিত নতুনপ্রজন্ম: দু’একটি ছাড়া গণমাধ্যমে নতুন প্রজন্মের অগ্রসর চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা কিংবা সফলতা-ব্যর্থতার গল্পগুলো একেবারেই উপেক্ষিত। প্রতিটি গণমাধ্যমে তরুণদের জন্য বিশেষ বিভাগ রাখা হলেও তা খুবই গতানুগতিক। যেখানে ক্যাম্পাস কিংবা একাডেমিক বিষয়গুলোই তুলে আনা হয়। সমকালীন রাজনীতি কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের তরুণদের মতামত প্রচার পায় না। তাছাড়া রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে তরুণদের মুক্তমত সেন্সর করা হয়। বেশিরভাগ প্রিন্টমিডিয়ায় প্রকাশের জন্য যেসব প্রতিবেদন/কনটেন্ট নির্বাচন বা নির্ধারণ করা হয় তাতে উপেক্ষিত থাকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নায়ক তরুণরা। আবার তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত বিষয়কে যেভাবে প্রচার করা হয় সেভাবে মৌলবিজ্ঞান বিষয়ক লেখা প্রকাশিত হয় না।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানবিষয়ক লেখা যতটা না চোখে পড়ে, তার চেয়ে বেশি দেখা যায় ধর্মবিষয়ক লেখা। মৌলবিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানের দর্শনবিষয়ক লেখা প্রকাশে তীব্র অনীহা দেখা যায়। সর্ব পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের একঘেয়ে গুরুত্বহীন বক্তব্যকে যেভাবে তুলে ধরা হয় সেভাবে তরুণ উদ্যোক্তাদের কথা বলা হয় না। এমন প্রবণতা দেখা যায়, সদ্য বাজারে আসা অনেক প্রিন্টমিডিয়াগুলোতেও।

ভেতরে-বাইরে এমন বহুবিধ সংকটের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রিন্টমিডিয়া। প্রচার সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে কমতে থাকলেও (বিশেষ করে করোনাকালীন) সরকারি বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়ছে না। আর এটিকেই টিকে থাকার মাপকাঠি হিসেবে ধরা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, বেশিরভাগ উদ্যোক্তা তাদের পরিচালিত গণমাধ্যমকে পাঠকপ্রিয় ও জনপ্রিয় করতে যতটা না স্বপ্ন দেখেন তারচেয়ে বেশি ভাবেন ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করতে। একইসঙ্গে ‘গণমাধ্যম বিজনেসে’ গণমাধ্যমকর্মীদের সৃজনশীল উৎপাদক না ভেবে ‘শ্রমিক, চাকরিজীবী বা উদ্ধারকারী’ হিসেবেই ভাবতে চান উদ্যোক্তারা। আর তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সমান্তরাল ভূমিকাই পালন করে থাকেন পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা। এতে করে নতুন সৃজনশীল কর্মপরিকল্পনার কোনো সুযোগই থাকে না।

চূড়ান্তভাবে, কিছু ব্যক্তির অমানবিকতা, ভণ্ডামি আর স্বার্থপরতায় সৃষ্ট গণমাধ্যমের এসব বাস্তবতার করুণ পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে সংবাদকর্মীদের। চোখে মুখে সীমাহীন স্বপ্ন আর সম্ভাবনা নিয়ে যারা এসে ঢুকে পড়েছিলেন ‘মহান’ এ পেশায়। অথচ কর্মস্থলের বিরূপ পরিবেশ, আত্মসম্মান বিসর্জন, ক্ষণে ক্ষণে চাকরি হারানোর শঙ্কা আর শেষ বয়সে শূন্য হাতে পরিবারের কাছে ফেরার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা দিয়েই শেষ হচ্ছে সভ্যতার সবচেয়ে ‘মহান’ জীবনের জার্নি।

অবশ্য অনেকেই স্বপ্ন দেখছেন, একবিংশ শতকে এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। যেখান থেকে নতুন এক পথচলা শুরু হতে পারে। যার অগ্রভাবে থাকতে পারেন আজকের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অগ্রনায়ক তরুণরা। গণমাধ্যমের বর্তমান বাস্তবতায় যারা হতাশ হলেও হাল ছাড়তে রাজি নন।

লেখক: সাংবাদিক। 

মতামত বিভাগের আরো খবর
নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ