ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে


গো নিউজ২৪ | নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২০, ০৪:২৮ পিএম আপডেট: ডিসেম্বর ১২, ২০২০, ১০:২৮ এএম
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বেতন কাঠামোর মধ্যে থেকে যদি চাকরিজীবীদের পরিবার স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারে, তবে দুর্নীতি তো বটেই অনেক অনিয়মই হ্রাস পাওয়া স্বাভাবিক।

বরেণ্য কথাশিল্পী শওকত ওসমান ১৯৭৪ সালে লিখেছিলেন তার বিখ্যাত একটি নাটক 'আমি কেন বেতন পাই'। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ঠাসা নাটকের প্রধান চরিত্রটি অফিসের চাকরি। প্রতিদিন অফিসে যান, তবে তার সময় কাটে আড্ডা মেরে। কোনো কাজ করে না সে। তার কোনো কাজ নেই অফিসে। তাই খই ভাজার মতো অবস্থা।

এক সময়ে নিজের মনেই প্রশ্ন জাগে- 'আমি কেন বেতন পাই?' এবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা আরেক দফা বৃদ্ধির প্রস্তাব ও সুপারিশ দেখে শওকত ওসমানের সেই বিখ্যাত নাটকটির কথা মনে পড়তেই পারে।

প্রশাসনকে গতিশীল করার জন্য যেমন মেধাবী, দক্ষ, সৎ, কর্মনিষ্ঠ, কুশলী, চৌকস কর্মকর্তা কর্মচারী প্রয়োজন, তেমনি তাদের জীবনযাপনকে সহনশীল রাখার জন্য গতিশীল ও জীবনধারক বেতন কাঠামোও জরুরি। বেতন বৃদ্ধি চাকরিজীবীদের জন্য সুসংবাদ বৈকি।

সরকারি কর্মজীবীদের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ নির্দিষ্ট আয়ের সীমায় তাদের জীবন নির্বাহ করতে হয়। আর্থিক দুশ্চিন্তামুক্ত থাকলে যে কোনো মানুষেরই কর্মক্ষমতা বাড়ে। কাজের মানের উন্নতি হয়; সব কিছুই গতিশীল হয়। তাই বছরের শেষ প্রান্তে প্রায় ১৪ লাখ সরকারি কর্মজীবীর জন্য নয়া বেতন স্কেল ঘোষণা প্রশাসনে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনতে ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা পালন করবে সন্দেহ নেই।

মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে সরকারি পর্যায়ের বেতন কাঠামো বেসরকারি বেতন কাঠামোর তুলনায় অনেকটাই মস্নান বলা যায়। বেসরকারি খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান আকর্ষণীয় বেতন ভাতা প্রদান করে মেধাবী ও উদ্যমী তরুণ-তরুণীদের নিয়োগ দিচ্ছে। বিশ্বায়নের এই যুগে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক দেশও বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। সে তুলনায় সরকারি চাকরির একক কৌলিন্য তেমন নেই। বৈষয়িক প্রণোদনা ছাড়া কেবল দেশপ্রেম আর সমাজ ভাবনার আহ্বান দিয়ে আকর্ষণ করা যায়নি দীর্ঘসময়।

ফলে মেধাহীন চেতনায় দুর্নীতি, কম জানা, অনভিজ্ঞদের ভিড় বেড়েছে সরকারি চাকরিতে। নানা তদ্বীর ও সুপারিশে যেন মেধাহীনদের আশ্রয়স্থল সরকারি দফতর-অধিদফতরগুলোও।

মেধাবী, দক্ষ ও ইংরেজি জানা উদ্যমীরা সরকারি চাকরিতে আগ্রহী হবে। আর এমন কর্মজীবীরাই দেশকে গতিশীল ও উন্নত দেশে পরিণত করার ক্ষেত্রে হবে সহায়ক উপাদান। এর আগেও সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানোর পদক্ষেপ যে সর্বোতভাবে সুফল বয়ে এনেছে, তা কিন্তু নয়।

বরং তিক্ত অভিজ্ঞতার বহর বেড়েছে। বাড়তি যে বেতন মেলে তার একটা অংশ গ্রাস করে মূল্যস্ফীতি। ফলে বর্ধিত বেতন গলার কাঁটা হয়ে ওঠার ইতিহাসও রয়েছে। জনগণের বিভিন্ন অংশের ওপরও বেতন বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। তাদের তো আর বেতন বাড়ে না, কিন্তু উত্তাপ সহ্য করতে হয় বাজারে বেতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পণ্যমূল্য বাড়ার আগুনে।

সরকারি কর্মকর্তাদের সচ্ছল, আরামদায়ক জীবনযাপন, উন্নত লাইফস্টাইল নিশ্চিত করার বিনিময়ে সাধারণ জনগণ কি পাবে- আজ এ প্রশ্ন জাগছে সবার মনে। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, ঘুষ, দুর্নীতির বেড়াজাল থেকে প্রশাসনকে মুক্ত করা সম্ভব কিনা- সেটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি জনবান্ধব না হন, সাধারণ মানুষ যদি তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সেবা না পান, তারা যদি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে থেকে নিজের দায়িত্বের প্রতি যত্নশীল না হন, দেশের উন্নয়নে সাধারণ মানুষের সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের জন্য যদি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমিটমেন্ট না থাকে তাহলে সব প্রচেষ্টাই ভুল হয়ে যেতে বাধ্য। 

বেতন বাড়লে ব্যয়ও বাড়ে, পণ্য ও সেবা কেনার প্রবণতা বাড়ে, যার প্রভাবে বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ে। এটা সাধারণ প্রবণতা।

সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার সামান্য একটি অংশ মাত্র। সরকারি চাকরিজীবীদের বর্ধিত বেতন ভাতার অর্থের সংস্থান করতে সরকার নানাভাবে কর বৃদ্ধির আয়োজন করছে। যার চাপে পিষ্ট হতে হবে গোটা দেশের মানুষকে। যাদের মধ্যে সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। তারা সরকারি চাকরির বেতন ভাতার সুবিধাভোগী নন কোনোভাবেই। তবে পে-স্কেল বাস্তবায়ন পরবর্তী যাবতীয় প্রতিকূল পরিস্থিতির পুরোপুরি শিকার হতে হবে তাদের। পে-স্কেল বাস্তবায়নের পর স্বাভাবিকভাবে বাড়ি ভাড়া বাড়বে। যানবাহনের ভাড়া বাড়বে। এমনিতেই বাড়িওলাদের বছর বছর ভাড়া বৃদ্ধির যাতনায় পিষ্ট সাধারণ নাগরিক। অনেকটা অসহায় অবস্থার মধ্যে বছরের পর বছর পার করতে হয় তাদের। এক মাসের নোটিসে বাসা ভাড়ার পরিমাণ এক লাফে কয়েক হাজার টাকা বাড়ানো বাড়িওয়ালাদের জন্য ডালভাত ব্যাপার। কত টাকা বাড়ি ভাড়া নির্ধারিত হবে তা নির্ভর করে বাড়িওয়ালার মর্জির ওপর। কত টাকা ভাড়া বাড়বে তাও ভাড়াটিয়ার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে মালিকের ইচ্ছার ওপর।

কাঙ্ক্ষিত হারে সরকার যদি রাজস্ব আদায় করতে না পারে তাহলে বর্ধিত বেতন ভাতার অর্থের সংস্থানের জন্য উন্নয়ন বরাদ্দ বা সামাজিক খাতের বাজেট কাটছাঁট করতে হবে। নতুবা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির হাত থেকে রেহাই মিলবে না।

বিশ্লেষকদের মতে, পৃথিবীর কোনো দেশেই বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রে জিডিপির অনুপাতে এক সঙ্গে এত বড় প্রবৃদ্ধি হয় না। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ প্রস্তাব অনেকটা অস্বাভাবিক। আর এ খরচ মেটাতে গিয়ে বাজেটের অন্য খাত বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তো থাকছেই। নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব পড়ে বাজারেও। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ছে বাজারে চাউর হওয়ার পর থেকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করে। 

সরকারি চাকরিজীবীরা অনিয়ম আর দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে দেশ। এমন অভিযোগ দেশের আপমার জনগণের। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান চালিকাশক্তি প্রশাসনিক পর্যায়ে দুর্নীতি কমাতে যথাযথভাবে পে-কমিশন বাস্তবায়ন জরুরি। জাতীয় পে-কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন স্কেল নির্ধারিত হলে প্রশাসনিক পর্যায়ে দুর্নীতি কমে আসতে পারে ব্যাপকভাবে। এর ফলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও দূর হবে বলে মনে করেন অনেকেই।

কিন্তু চাকরিতে বেতনের বাইরে উপরি পেয়ে যাদের অভ্যাস হয়ে গেছে, যাদের রক্তে দুর্নীতি আর অনিয়মের বিষাক্ত জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে তারা খুব সহজেই নিজেদের পাল্টে ফেলতে পারবেন তেমনি গ্যারান্টি দেয়া যায় না। সব সময় ঘুষ নিয়ে যাদের অভ্যাস হয়ে গেছে তাদের বেতন ভাতার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলেও ঘুষ নেয়া থেকে বিরত হতে পারবেন বলে মনে হয় না।

মতামত বিভাগের আরো খবর
নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ