ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সড়কে (কুড়িল থেকে রামপুরা হয়ে সায়েদাবাদ পর্যন্ত মূল সড়ক, শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি, গাবতলী থেকে আসাদগেট) রিকশা চলাচল বন্ধ হয়েছে ৭ জুলাই। যানজট কমানোর লক্ষ্যে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এই উদ্যোগ নেয়। দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, যানজট নিরসনে রাজধানীর মূল সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল বন্ধ করার কোন বিকল্প নেই। এরপর থেকেই সড়কে রিকশা বন্ধের পক্ষে-বিপক্ষে সামাজিক মাধ্যমে মতামত তুলে ধরছেন অনেকেই।
তবে রিকশা বন্ধই যে যানজট নিরসনের একমাত্র উপায় তা কিন্তু অনেকেই মনে করেন না।
রিকশা তুলে দেয়ার পাশাপাশি গাড়ির পার্কিং নিয়ন্ত্রণ, ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ, সিসিটিভি দ্বারা সব রাস্তা নিয়ন্ত্রণসহ ট্রাফিক আইন ব্যবস্থার প্রয়োগও জরুরী বলে মনে করেন অনেকে।
এদিকে মঙ্গলবার রিকশা বন্ধের প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করেন রিকশাচালকরা। এতে অচল হয়ে যায় গোটা রাজধানী শহর। বুধবার ফের সড়ক অবরোধের ঘোষণা থাকলেও সেটা কার্যত দেখা যায়নি। গরিব মানুষগুলো কয়দিনই বা কাজকর্ম বন্ধ করে আন্দোলন করতে পারবে। স্ত্রী-সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেয়া, সপ্তাহ শেষে কিস্তির টাকা জোগাড়, বাবা-মায়ের ওষুধের পয়সার কথা মনে হলেই আন্দোলন-সংগ্রামের শক্তি শেষ হয়ে যায় তাদের।
ঢাকার দুই সিটিতে কি পরিমাণ রিকশা চলে তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যান নেই। যদিও বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ঢাকায় ১১ লাখের বেশি রিকশা রয়েছে বলে জানা যায়। আর এর মধ্যে মাত্র ৭৯ হাজার রিকশা সিটি কর্পোরেশনে নিবন্ধিত। ১৯৮৬ সালের পর থেকে ঢাকায় রিকশার নিবন্ধন বন্ধ। তবে প্রতিদিনই অবৈধভাবে নতুন রিকশা নামছে রাস্তায়। আর এসব রিকশার চালক ও মালিকদের নিয়ে রাজধানীতে গড়ে উঠেছে অন্তত ২৮টি সংগঠন। এসব সংগঠনই নিজেদের মনগড়া ‘লাইসেন্স’ দিয়ে রিকশা নামায় সড়কে।
এর প্রেক্ষিতে বলা চলে ঢাকার অবৈধ রিকশাগুলো জব্দ করতে পারলে কোনো সড়কেই রিকশা চলাচল একেবারে বন্ধ করা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এই বিপুল সংখ্যক রিকশা কী আসলেই জব্দ করা সম্ভব?কেননা রিকশা অবৈধ হলেও চালকদের শ্রম কিন্তু অবৈধ নয়। তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পরিবার-পরিজনের মুখে খাবার তুলে দেয়।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ঢাকা শহরে যত সড়ক আছে সেগুলো একত্রিত করলে ২০ হাজার কিলোমিটার হয়। কিন্তু আমরা রিকশা বন্ধ করতে পেরেছি মাত্র ১০ কিলোমিটার সড়কে। আমাদের পরিকল্পনা আছে দুই বছরের মধ্যে ঢাকাকে রিকশাশূন্য করার।
এখন কথা হচ্ছে দুই বছরের মধ্যে ঢাকাকে রিকশাশূন্য করতে হলে এই সময়ের মধ্যেই তাদের জন্য বিকল্প উপার্জনের পথ তৈরী করতে হবে। রিকশার ওপর নির্ভরশীল এই বিপুল সংখ্যক মানুষের অধিকাংশই গ্রামে পরিবার রেখে রাজধানী আসে অর্থ উপার্জনের আশায়।
রিকশা বন্ধ হলেও তাদের উপার্জন কিন্তু বন্ধ করা যাবে না। প্রয়োজনের তাগিদেই ভিন্ন কোনো পেশায় নিয়োজিত হতে হবে। তবে সেই পেশা ঢাকা কেন্দ্রীক না হয়ে হতে হবে গ্রাম কেন্দ্রীক। তা যদি না হয় তাহলে সমস্যা আরো বাড়বে ছাড়া কমবে না।
এখন আসা যাক সরকার আসলে তাদের ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না বা সেরকম কোনো পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে কি না।
বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-তে একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার আছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘আমার গ্রাম–আমার শহর’: প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগরসুবিধা সম্প্রসারণ করা হবে। আমরা নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করলে প্রতিটি গ্রামকে শহরে উন্নীত করার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করব। শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেব।
এছাড়া বলা হয়, আগামী পাঁচ বছরে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। পাকা সড়কের মাধ্যমে সকল গ্রামকে জেলা-উপজেলা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। সুপেয় পানি এবং উন্নত মানের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। কর্মসংস্থানের জন্য জেলা-উপজেলায় কলকারখানা গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে যাবে।
ইশতেহারে বলা হয়েছে, এই অঙ্গীকারের মধ্যে ইতিবাচক উপাদান আছে। সবচেয়ে ইতিবাচক হলো, উন্নয়নচিন্তার মধ্যে গ্রামকে স্থান দেওয়া। নাগরিক আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা এবং নাগরিক অধিকার গ্রামেও নিশ্চিত করা। এক কথায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ‘গ্রাম হবে শহর’।
এখন ডিএনসিসির মেয়রের ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকাকে যদি দুই বছরের মধ্যে রিকশামুক্ত করতে হয় তাহলে আগামী দুই বছরের মধ্যেই ইশতেহার অনুযায়ী ‘গ্রাম হবে শহর’ এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই নিশ্চিন্তে এই সকল অতি সাধারণ মানুষগুলো রাজধানী ছেড়ে নিজের জন্মস্থানেই কাজের সন্ধান করে নেবে এবং রাজধানীকে রিকশামুক্ত করা সম্ভব হবে। অন্যথায় জোর করে তাদেরকে শহর ছাড়া করতে চাইলে সেটা হবে ‘গরীবের ওপর জুলুম’।
গো নিউজ২৪/আই