ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্রেসিডেন্ট এরশাদ’


গো নিউজ২৪ | ড. এম এ মোমেন প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০১৯, ০৫:১৪ পিএম আপডেট: জুলাই ৩, ২০১৯, ১১:১৪ এএম
‘প্রেসিডেন্ট এরশাদ’

একটি অতি আবশ্যকীয় ঘোষণা আগে দিয়ে নিই : আমি রাজনীতির প্রতি সামান্যতম আগ্রহী নই এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির প্রতিও না।

প্রেসিডেন্ট এরশাদের ভজনা করা যেসব শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ তার কাছ থেকে বহুমূল্যের প্লটসহ খেতাব এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছিলেন; নব্বইয়ে তার পতনের পর প্রায় সবাই চেহারা পাল্টে ফেললেন, ‘স্বৈরাচারী এরশাদ’ বলে শোর তুললেন। আমি আমার বেতনের অতিরিক্ত কিছু পাইনি, কখনো চাইওনি। সাবেক প্রেসিডেন্টকে নিয়ে রাজনীতিবিদরা যত গালমন্দ ও বিতর্ক করুন, যেহেতু আমার সরকারি চাকরি জীবনের প্রথম যুগের আটটি বছর তারই আমল, আমি কিঞ্চিৎ হলেও তখনকার বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্টের স্নেহস্পর্শ পেয়েছি। তার জীবদ্দশায় আমার সীমিত সাধ্যের মধ্যে তাকে নিয়ে একটি লেখা তৈরি করা আমার নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করছি। তার কাছ থেকে যারা অনুগ্রহ (ফেভারের চেয়ে ভালো বাংলা শব্দ আমার জানা নেই) পেয়েছেন, তারা লিখবেন না এটাই স্বাভাবিক, তারা রং বদলে নিয়েছেন। 

সরকারি চাকরিতে থাকলেও যেদিন আমার স্কুলজীবনের ক্লাসমেট ডাক্তার শামসুল আলম মিলন নিহত হলেন, আমিও একান্তভাবে তার এবং তার সরকারের পতন চেয়েছি। সরকারি চাকরিতে না থাকলে হয়তো আমিও মিছিলের একজনই হতাম। আবার গত শতকের নব্বইয়ের দশকের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বছর থেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির যে সূর্যরশ্মিটি দেখা দেয়, আমার বিবেচনা শক্তি স্পষ্টভাবে বলে দেয়, এর কৃতিত্ব যদি দিতে হয় তা এরশাদেরই প্রাপ্য হবেন, বিশেষ করে তার সময়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন।

আমি তার কথিত স্বপ্নদর্শন এবং পরদিন কোনো মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায়ে স্বপ্নের ইতিকথা বিশ্বাস করিনি এবং পছন্দও করিনি। এমনকি পছন্দ করিনি কলেজ ম্যাগাজিন মানের কবিতা প্রকাশের অব্যাহত চেষ্টা। তার পাশে যারা ছিলেন, কবি ও বুদ্ধিজীবী, তারা নিশ্চয়ই তাকে আরও উৎসাহিত করেছেন। বলা আবশ্যক, আমি কখনোই তার সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পাইনি, বিভিন্ন সময়ে তার সান্নিধ্যে আসার সুবাদে কয়েকটি ছোট অ্যাপিসোড নিয়েই এই রচনা ‘প্রেসিডেন্ট এরশাদ’। এই লেখাটির একটি সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নিতে চাই। এটি অনেকটা আধো অন্ধের হস্তী দর্শনের মতোন কেবল একাংশ দর্শন। যারা আমার উল্টোদিকটা নিজ চোখে দেখেছেন, তাদের বিবরণ ভিন্ন হতে বাধ্য।

এক.

১৯৮৮-এর মধ্য ফেব্রুয়ারি। জাতীয় ভূমি সংস্কার বোর্ডের প্রথম বৈঠক। বৈঠকটি হবে বঙ্গভবনের সভাকক্ষে, সভাপতিত্ব করবেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তখনকার ভূমি সচিব এম মোকাম্মেল হক আমাকে কক্সবাজার থেকে তুলে এনে মন্ত্রণালয়ের ভূমি সংস্কার কোষের সহকারী সচিবের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার চাকরির প্রথম সপ্তাহ পার না হতেই এত বড় বৈঠকের মুখোমুখি। দুটি কার্যপত্র ‘ভূমিহীনদের মধ্যে ভূমিবণ্টন’ এবং ‘গুচ্ছগ্রাম’ আমাকেই লিখতে হয়েছে। বৈঠকের আগের রাতে মোট আটটি কী নয়টি কার্যপত্র সাইক্লোস্টাইল করিয়ে, যথার্থতা যাচাই করে মিটিং ফোল্ডারে ভরে সকাল ৮টার মধ্যে আমাকে বঙ্গভবনে পৌঁছে বৈঠকের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। একজন পিয়ন, একজন টাইপিস্ট এবং সাইক্লোস্টাইল অপারেটর আর আমি প্রায় না খাওয়া অবস্থায় সারা রাত জেগে কাজটা শেষ করি। রাত ১১টার দিকে সচিব সাহেব কাজের অগ্রগতি দেখতে এলেন। আমি ভয়ংকর ক্ষুব্ধ, তখন আমরা পনেরোজন সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব কর্মরত। কিন্তু এত কাজ আমাকেই একা কেন করতে হবে? সেই রাতে ক্ষোভের সঙ্গে অনেকটা চেঁচিয়েই সচিবকে তা জিজ্ঞেস করায়, সচিব আমার এহেন অ-কর্মকর্তাসুলভ আচরণ সহ্য করে গম্ভীর স্বরে বললেন, এটাই নিয়ম, কাজ একজন বা দুজনই করে। সামান্যতম সহানুভূতি প্রকাশ না করে তিনি চলে যাওয়ায় আমার নিঃশব্দ অশ্রুপাত চলতে থাকে।

অফিস থেকে সরাসরি বঙ্গভবন। জীবনে প্রথম প্রেসিডেন্টের দপ্তরে প্রবেশ। সভাকক্ষে চেয়ারের সামনে কার্যপত্রের ফোল্ডার তো রাখলাম, কিন্তু কোন মন্ত্রীর পর কে বসবেন সেই নামফলকগুলো সাজাব কেমন করে, আমার তো বিধিবিধানটাই জানা নেই। হিমশীতল সভাকক্ষেও ঘেমে উঠছি। হঠাৎ পিঠে কোমল হাত, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মন্ত্রী এ কে খোন্দকার। বললেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তালিকাটি নাও, সেই তালিকা ধরে একজন ডানে পরের জন বাঁয়ে এভাবে সিরিয়াল ধরে বসিয়ে যাও; কিন্তু সে তালিকাই বা পাব কোথায়? নিশ্চয় অফিসে ছিল, কিন্তু এ পরামর্শ তো কারুর কাছ থেকে পাইনি। ভেতরে আকস্মিকভাবে পেয়ে গেলাম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সহকারী সচিব এম এ এন সিদ্দিকীকে (পরে যোগাযোগ সচিব), বলতেই তিনি তালিকাটি হাতে দিলেন, আমার ঘাম ঝরা বন্ধ হলো। মিটিং শুরুর কয়েক মিনিট আগে সচিব মোকাম্মেল হক এলেন, চারদিক তাকিয়ে বললেন, সব ঠিক আছে তো? আমার ক্রোধ আবার জেগে ওঠে। তিনি বললেন, চলো প্রেসিডেন্ট সাহেবকে নিয়ে আসি। এটি অবিশ্বাস্য কাণ্ড! আমার অবস্থানের কারুর প্রেসিডেন্টের কক্ষে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে পিএসএফ, পিজিআরসহ অনেক বাহিনী কাজ করে। প্রেসিডেন্টের কক্ষের কাছাকাছি এসে তিনি কাউকে বললেন, ও আমার সঙ্গে ভেতরে যাবে।

আমিও তার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের রুমে ঢুকলাম। নিজের কথাকে প্রতিষ্ঠিত করার একটি অসাধারণ স্টাইল ছিল মোকাম্মেল হকের। তিনি ভেতরে ঢুকেই প্রেসিডেন্টকে বললেন, স্যার আপনার কাছে এই ছেলেটিকে নিয়ে এসেছি শুধু এটা বলার জন্য, আপনার ভূমি সংস্কার বৈঠকের অনেকগুলো ‘ওয়ান্টিং পেপার’ ও নিজে লিখেছে আর কাল সারা রাত জেগে মিটিং ফোল্ডার রেডি করেছে। প্রেসিডেন্ট সাহেব চেয়ার থেকে উঠে এসে আমার পিঠে হাত রাখলেন, স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাকেই তো চাই’। আমার সব ক্ষোভ কোথায় যে মিলিয়ে গেল, আমার চোখ আবার অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। চাকরি জীবনের শুরুতে এ এক অসাধারণ প্রাপ্তি। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা কৃতিত্ব নেন, এটাই অভিযোগ, কিন্তু মোকাম্মেল হক তো এমনকি তার নিজের কাজসহ আরও অনেকের কাজের কৃতিত্ব প্রেসিডেন্টের সামনে মন্ত্রণালয়ের সে সময় কনিষ্ঠতমদের একজন আমাকেই দিলেন। সেই বৈঠকের কার্যবিবরণীও আমি লিখেছি। সচিব সেই কার্যবিবরণী প্রেসিডেন্টকে দিয়ে সই করিয়ে আনলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে এমন স্নেহবর্ষণ সুলভ নয়, তাও দেশের রাষ্ট্রপতির।

দুই.

ঋণ সালিশি বোর্ডের জাতীয় কমিটির প্রথম বৈঠক। এ কাজেরও ডেস্ক অফিসার আমি। এত দিনে বঙ্গভবনের কর্মপদ্ধতি কিছুটা রপ্ত হয়ে গেছে। সভাপতিত্ব করবেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। আমার কাজ বিস্তারিত কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করা। সেদিন আমি এমনিতেই ফ্লু আক্রান্ত। সভা শুরু হয়ে গেছে। অতি শীতল কক্ষ আমার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে, একটি রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরে রেখেছি, যাতে শব্দ না হয়। এত বড় সভায় এমন অনুল্লেখ্য একজন মানুষের অস্বস্তি কেমন করে দেশের প্রেসিডেন্টের নজরে আসবে? হঠাৎ দেখলাম আমার পেছন থেকে একজন একটি সুন্দর পিরিচে আদাকুচি ও লবণ আমার সামনে রাখলেন।

পেছনের লোকটি ফিসফিস করে বললেন, আমি এডিসি, প্রেসিডেন্ট স্যার বললেন আপনাকে দিতে। দূর থেকে আমি প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাই, তিনি হাত ইশারায় যা দেখালেন তার মানে, খাও, কাশি কমে যাবে। এই কৃতজ্ঞতাটি আমি প্রকাশ করতে চাই।

তিন.

এ রকম টুকরো টুকরো আরও কিছু ঘটনার স্মৃতি আমার কাছে জমে আছে। একবার প্রেসিডেন্টের সফরসঙ্গী ছিলেন বিদেশি সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তখনকার পরিচালক ফজলে রাব্বির মাধ্যমে এই বিদেশির সঙ্গে আলাপ, তার ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ নিয়ে অনেক কথা। খানিকটা দূরে চোখ পড়তে অ্যান্থনিকে (পরিচিতজন তাকে টনি বলতেন) যখন ‘হাই’ করি, তিনি নিরাপত্তা-বেড়ির বাইরে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন আর প্রেসিডেন্ট তার নিজস্ব কায়দায় জিজ্ঞেস করেন, ‘নোন টু ইচ আদার?’

চার.

চাকরি জীবনে আমি দুজন মহামান্য প্রেসিডেন্টের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেছি, একজন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও কদিন কাটিয়েছি। তবে তাদের সবাই দ্বাদশ সংশোধনী-পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ায় অপর এক প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সাহাবুদ্দীনের ভাষায়, তাদের মাজার জিয়ারত ও মিলাদ পড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ না থাকারই কথা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট এরশাদ ছিলেন সব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। সাবেক হওয়ার পর একবার তিনি রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ চাচ্ছেন। কেউ একজন আমায় দাপ্তরিক ফোন করে বললেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেব কথা বলবেন। ফোন ধরতেই তিনি বললেন, আমি জানি আপনি ওখানে আছেন। আমি বললাম, স্যার আপনি আমাকে আগে তুমি বলতেন। ওহ আচ্ছা, বলে তিনি প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ চাইলেন। আমি বললাম, স্যার মিলিটারি সেক্রেটারিকে বলুন। তিনি বললেন, আমি এখন একজন সিভিলিয়ান হিসেবে সিভিল চ্যানেলেই যেতে চাই। আমি বললাম, স্যার আমি আপনাকে জানাব। প্রেসিডেন্টকে জানালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি দিলেন। কিন্তু তখনকার একটি অলিখিত বিধান অনুযায়ী ‘সংবেদনশীল সাক্ষাৎকার’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি আমাকে অপেক্ষমাণ রেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের রেড জোন ঘুরে এসে বললেন, সাজেশন হচ্ছে ‘গো স্লো’। সুতরাং এই সাক্ষাৎকারটি ঝুলে গেল। সাবেক প্রেসিডেন্ট সাহেবকে হ্যাঁ কিংবা না স্পষ্ট কিছু বলতে না পারায় আমিও বিব্রতবোধ করছিলাম। একটি অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে গেল, ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সাক্ষাৎকারের কী করলে? আমার এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না। আপনি তো অনেক বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন, আপনি তো জানেনই। আমি ইতস্তত করতে থাকলাম। তিনি আমার ঘাড়ে আলতো টোকা দিয়ে বললেন, ‘ডোন্ট অরি, তবে চেষ্টা চালিয়ে যাও, কখনো হ্যাঁ হলে ফোন করো।’ সেই হ্যাঁ হওয়ার আগেই আমি ওএসডি হয়ে গেলাম।

পাঁচ.

আর একটি ঘটনা বলতেই হয় : অনেকটা হাতে পায়ে-ধরেই আমার চিকিৎসক স্ত্রীকে চীনা দূতাবাসে তাদের সরকারের একটি রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনায় নিয়ে যেতে সক্ষম হলাম। পেশাগত কারণে সে তার সন্ধ্যাটা পেশার বাইরে থাকতে চায় না। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদের সঙ্গে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বিদিশাকে দেখে আমার স্ত্রী কৌতূহলী হয়ে উঠল। এ কৌতূহল কেবল নারীর নয়, পুরুষেরও হওয়ার কথা। কাছাকাছি এসে আমিই তার দৃষ্টিতে পড়ার অপেক্ষায় ছিলাম। সৌভাগ্যই বলব, তিনি দেখলেন এবং আমাকে নাম ধরে ডেকে বললেন, এসো, তোমার ভাবি। তিনি নাম ধরে ডেকেছেন, এতেই আমার স্ত্রীর কাছে আমার মর্যাদা কিছুটা বেড়ে গেল, দ্বিতীয় ওর কাছাকাছি গিয়ে যখন বললাম, ভাবি তো আসলে আমার ভাতিজি হওয়ার কথা, আবু বকর সিদ্দিকী ভাইয়ের মেয়ে। সে হিসেবে আপনি... আমি আর এগোইনি, তিনি বললেন, তাহলে তো তুমি মুরব্বি হয়ে যাচ্ছো!

ছয়.

২০০৭ সালে একাধিক টেলিভিশনের টকশোতে বেসামরিক বিমান পরিবহন খাত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ বিমানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভালোমন্দ নিয়েও কিছু কথা বলি। আমার সেই আলোচনা প্রেসিডেন্ট এরশাদ দেখবেন বা শুনে থাকবেন এটা আমার চিন্তায়ও থাকার কথা নয়। অনেক দিন পর বছরের শেষ দিকে আর একবার তার সামনে পড়ে গেলে তিনি বললেন, আমি তোমার ওপর খুব অসন্তুষ্ট হয়ে আছি। তুমি টকশোতে এত কথা বললে কিন্তু আমি যে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস থেকে বিমানের জন্য ডিসি টেনগুলো আনিয়ে দিয়েছিলাম, সে কথা তো বললে না। সেদিন টকশোতে সঞ্চালক যেসব প্রশ্ন করছিলেন, তাতে পেছনে গিয়ে ডিসি টেন কাহিনী বলার সুযোগও ছিল না। তবুও তাকে বললাম, স্যার, ভুল করে ফেলেছি। নেক্সট টাইম উল্লেখ করব। আর একবার তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, কী নিয়ে পিএইচডি করলে? বললাম, বড় প্রেক্ষাপট অর্থনীতি হলেও আমার সুনির্দিষ্ট বিষয় ‘বাংলাদেশের ভূমি সংস্কার ও ভূমি ব্যবস্থাপনা’। ১৯৮৭-৮৮-এর ভূমি সংস্কার উদ্যোগ যেভাবেই মূল্যায়ন করা হোক, আমি জোর দিয়েই বলি, এরপর ভূমি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু আদৌ হয়নি। তার আমলের ভূমি সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন একটি অসামান্য দলিল। ১৯৮৮-তে আমি একাধিকবার পুলকিত হয়েছি, যখন প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমার লেখা ও ভূমিসচিব মোকাম্মেল হকের হাতে আরও সমৃদ্ধ হওয়া ভাষণটিই দিয়েছেন। আমার কথা দেশের প্রেসিডেন্টের মুখ দিয়ে বের হচ্ছে, সে সময়কার একজন সহকারী সচিবের জন্য কতটা আনন্দের ছিল, তা প্রকাশ করা খুব সহজ নয়।

 সাত.

তখন তিনিই প্রেসিডেন্ট। একটি কথা একান-ওকান হয়ে ঘুরতে ঘুরতে আমার কানে পৌঁছাল যে, সৈয়দ আলী আহসান তার কবিতাগুলো লিখে দেন। আমি মোটেও বিশ্বাস করিনি, কারণ সৈয়দ আলী আহসানের উচ্চমানের গদ্যপদ্য উভয়ের সঙ্গেই আমি পরিচিত। তবুও একটি বালখিল্যের আচরণ করেই ফেললাম, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, অনেককেই বলতে শুনেছি, প্রেসিডেন্ট সাহেবের কবিতা নাকি আপনি লিখে দেন? তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে পরপর দুবার উচ্চারণ করলেন মূর্খ, মূর্খ। তারপর বললেন, আমি লিখলে কবিতা হতো। তিনি আর কিছু বলেননি, আমি হিসাব করলাম, নিশ্চয়ই তার উচ্চারিত প্রথম মূর্খ গুজব রটনাকারী। আর দ্বিতীয় মূর্খ আমি, কারণ এ রকম বাজে একটা প্রশ্ন করেছি। লেখালেখির কারণে, বিশেষ করে ইংরেজি লিখতে পারার কারণে সৈয়দ আলী আহসানের কাছ থেকে বাড়তি প্রশ্রয় আদায় করে নিতে পারতাম। নতুবা তাকে মুখোমুখি এ রকম একটা প্রশ্ন করা অন্তত সে আমলে সহজ ছিল না।

প্রেসিডেন্ট এরশাদ হুট করে ক্ষমতা দখল করেননি। অনেকটা ঘোষণা দিয়ে বাদ্য বাজিয়েই এসেছেন। আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাকে কাজে লাগিয়ে দল গঠন করেছেন, নির্বাচন করেছেন, বিজয়ী হয়েছেন, দীর্ঘ সময় ক্ষমতাও ধরে রেখেছেন। ১৯৯০-এর ডিসেম্বরে তার ডুবন্ত তরী থেকে তার প্রিয়ভাজনরা কেমন করে লাফিয়ে পড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছেন, সে দৃশ্য অনেকেরই দেখা। অখ- পাকিস্তানের প্রতাপশালী শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ডায়েরি এবং কিছু সহযোগী গ্রন্থ পাঠ করে এমনই আমার মনে হয়েছে ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চের আংশিক পুনরাবৃত্তি ঘটেছে তার পতনের দিন। এ নিয়ে আগামী দিনের গবেষকরা লিখবেন। ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে আমার কিছু কিছু ভালো না লাগার কথাও বললাম। ডাক্তার মিলন কিংবা অন্য কাউকে তিনি নিজে গুলি করেননি, কিংবা গুলি করার আদেশও অন্তত প্রেসিডেন্টের দেওয়ার কথা নয়। পুরো ব্যাপারটি ঘটেছে একটি সরকারের বৃহত্তর ব্যর্থতা থেকে, যে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এ সময় তার দীর্ঘায়ু কামনা প্রসহনের মতো শোনাবে, আমি যেটুকু কৃতজ্ঞ সেই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে আমার চাওয়া সহি-সালামতে তার জীবনের অবসান ঘটুক। আর অনেক বছর পর নৈর্ব্যক্তিক কোনো ইতিহাসপ্রণেতার হাতে তার মূল্যায়ন হোক।

লেখক: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, লেখক ও কলামিস্ট

গো নিউজ২৪/আই

মতামত বিভাগের আরো খবর
নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ