ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মৃত্যু এত সহজ, জীবন এত সস্তা


গো নিউজ২৪ | গওহার নঈম ওয়ারা:  প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০১৮, ০৭:৫৫ পিএম
মৃত্যু এত সহজ, জীবন এত সস্তা

রাঙামাটি থেকে আবারো দুঃসংবাদ। গত বছর ঠিক এই দিনে, হাওরের হাহাকারের মধ্যেই ১২ জুন তারিখে রাঙ্গামাটি থেকে সব রেকর্ড ভাঙ্গা পাহাড় ধসের খবর এসেছিল। সেদিনের সেই ১৫২ জনের সঙ্গে এবারে যোগ হলো আরো এগারটি আদমসন্তানের নাম। সেবার ১৫২টি মৃতদেহ উদ্ধার হলেও এর বাইরেও থেকে যায় অনেকের লাশ। তাদের সঠিক সংখ্যা আমরা মনে রাখি নাই। বলা বাহুল্য নিহত (নাকি মৃত বলা বেশি সহি হবে) বেশির ভাগই ছিল নারী আর শিশু। সে তালিকায় সেনা সদস্যরাও ছিলেন। এর থেকেই বোঝা যায় কতোটা ভয়াবহ আর আচমকা ছিল সেই পাহাড় পতন। এই ঘটনার ঠিক এক বছর পর আজ যখন ১৫২ জনকে স্মরণ করার কথা, জাহির করবার কথা দুর্যোগ মোকাবেলার বলবান প্রস্তুতির কথা, তখন পাহাড় থেকে এলো সমীরণ ত্রিপুরার ফোন। একশ বায়ান্ন জনের গণমৃত্যুর এক বছর পূর্তির দিনটা আমরা উদযাপন করছি আরো এগারটি লাশ দিয়ে। সমীরণ নিশ্চিত করেছেন স্বাস্থ্য সেবিকা পুলদেবি চাকমা আর তার পরিবারের চার সদস্যের নিহত হওয়ার খবর। এই তালিকা সম্পূর্ণ নয়, নিখোঁজদের সবার খবর এখনো তিনি জানেন না। পুলদেবির নাম কি প্রশাসনের ঝুঁকি ঘোষিত তালিকায় ছিলো?

ঘটনাস্থল নানিয়ারচর রাঙ্গামাটি জেলার একটি উপজেলা। খাগড়াছড়ির লাগোয়া এই উপজেলার তিনটি ইউনিয়নই প্রাণঘাতি পাহাড় পতনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ভয়ংকর একটা কিছু ঘটার আলামত কয়েকদিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। দিন-রাতের টানা বৃষ্টিতে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়ে শেষমেষ পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এরই মধ্যে রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। নানিয়ারচর উপজেলা প্রশাসনের মতে সকাল সাড়ে এগারটা পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত সোমবার রাত ও মঙ্গলবার ( ১২ জুন) ভোরে নানিয়ারচর উপজেলার সাবেক্ষং ইউনিয়নের বড়পুলপাড়ায় চারজন, বুড়িঘাট ইউনিয়নের ধর্মচরণপাড়ায় চারজন ও ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের হাতিমারা গ্রামে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।

এ মৃত্যু কি এড়ানো সম্ভব ছিল? 
আমাদের সহকর্মী প্রণব বল ও সাধন বিকাশ চাকমা গত ২২ মে রাঙ্গামাটির হাল অবস্থা সরেজমিনে দেখে এসে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তাতে এরকম খারাপ কিছু ঘটার আশঙ্কা ছিল। তারা লিখেছিলেন পাহাড়ধসের এক বছর না যেতেই ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার পুনরায় ঝুঁকি নিয়ে বসবাস শুরু করেছে। এবার বর্ষায়ও পাহাড়ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ৩১টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে কেবল সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায়িত্ব সেরেছে, তেমন নজরদারিও নেই। ভূমিধসের কারণ চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণ বিষয়ে অনুসন্ধান কমিটি যেসব সুপারিশ দিয়েছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নও হয়নি।

ওই প্রতিবেদনে কর্তৃপক্ষের ‘দেখি না কী হয়’ নীতির কালো বিড়াল থলে থেকে বেরিয়ে আসে যখন সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা ঝুঁকির কথা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আসন্ন বর্ষা মৌসুমে কী হতে পারে, তা তুলে ধরেছি। কিন্তু বলা হয়েছে, যখন হয়, তখন ব্যবস্থা নেওয়া হবে………।’

রাঙ্গামাটি প্রশাসন চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে সারা জেলায় মোট ১৫০০০ মানুষকে ঝুঁকিতে ঝুলে থাকা জনগোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ঝুঁকিতে থাকা এই হতভাগ্য ৩,৩৭৮ পরিবারের মধ্যে ৬০৯টি পরিবার রাঙ্গামাটি পৌর এলাকায় বসবাস করেন। বাকিরা থাকেন সদর উপজেলা সহ অন্য আর ছয় উপজেলায়। এগুলো হলো, সদরঃ ৭৫০ পরিবার, জুরাইছড়িঃ ৬৪ পরিবার, ননিয়ারচরঃ ২৩৯ পরিবার, লংদুঃ ১০৮ পরিবার, বেলাইছরিঃ ২৪৫ পরিবার, কাউখালিঃ ১২০ পরিবার।

এইতো মাত্র কয়টা পরিবার, দশ লাখ শরণার্থী তুলনায় এই সংখ্যা নিতান্তই সামান্য। আমাদের সম্পদের কোন ঘাটতির কথা কি কেউ বলেছেন? তাহলে সম্পদ আছে, ঝুঁকিতে থাকে মানুষের হিসাব আছে, ঝড় বৃষ্টির খবর আছে, স্যাটলাইটের পূর্বাভাস আছে, তবু মানূষ কেন মরে?

তথাকথিত জনস্বার্থে পরিচালিত থলের বিড়ালটি কেঁদে ককিয়ে ওঠে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলাম (২০১৭ সালের পাহাড়ধসের পর ‘ভূমিধসের কারণ চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ শীর্ষক অনুসন্ধান কমিটি’র সদস্য) বলেন যে, স্বল্প, দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি কিছু সুপারিশ করা হয়েছিলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা রক্ষায় প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ, পুনর্বাসন, পাহাড় কাটা বন্ধ করার সুপারিশ। কিন্তু এসব সুপারিশের দৃশ্যমান কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। প্রশাসনিক আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফারাক আর গোলক ধাঁধাঁ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা জ্ঞান চর্চার জন্য হয়তো খুবই প্রয়োজনীয় কিন্তু মানুষের জন্য তা এক অশ্লীল আনুশীলন যদি না তা নাগরিকের প্রাণ আর সম্পদ রক্ষা করতে পারে।

রাঙামাটির খবরের পর প্রশাসনের মহান ‘দেখি না কী হয়’ নীতির প্রতিফলন টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতেও দেখতে পাব? পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জিকায় অবধারিতভাবে আরো আরো পাহাড়ধসে মৃত্যুর ঘটনা ঘটবেই? কিছুই কি করা হবে না? মৃত্যু এত সহজ, জীবন এত সস্তা এ দেশে?

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

গো নিউজ২৪/আই

মতামত বিভাগের আরো খবর
নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ