স্বস্তির নিঃশ্বাস ‘শকুনি লেক’ জুড়ে


ইমতিয়াজ আহমেদ, মাদারীপুর প্রকাশিত: জুলাই ২৮, ২০১৭, ০৯:১৪ এএম
স্বস্তির নিঃশ্বাস ‘শকুনি লেক’ জুড়ে

দৈনন্দিন জীবনের কর্ম ব্যস্ততায় শরীরে যেমন ক্লান্তি ভর করে, তেমনি ক্লান্তি এসে ভর করে মানুষের মনেও। মনের এই ক্লান্তি দূর করতে বিনোদন কেন্দ্রের বিকল্প নেই। একটু মানসিক প্রশান্তির জন্য মানুষ ঘুরতে বের হয় পরিবার বা প্রিয়জনকে নিয়ে। অবসাদ দূর হয়ে ঘরে ফেরে সতেজ-ফুরফুরে মেজাজ ও কাজের নতুন উদ্যোম নিয়ে। দেশের মফস্কল শহরগুলোতে তেমন কোন বিনোদন কেন্দ্র না থাকায় কখনো নদীর পার বা খোলা প্রান্তরে ঘুরে সময় কাটায় মানুষেরা। দূর করার চেষ্টা করে মনের ক্লান্তি।

সম্প্রতি উন্নয়নের মাধ্যমে সৌন্দর্য বর্ধনের ফলে মাদারীপুরবাসীর কাছে একমাত্র বিনোদন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সুবিশাল লেকটি। নাম শকুনি লেক। অপরূপ সাজে সজ্জিত এই লেকজুড়ে এখন বিনোদনপ্রেমী মানুষের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সারাদিনই ভ্রমন পিয়াসী মানুষের পদচারনায় এক রকম মুখোর থাকে এই শকুনি লেক। তবে দিনের সূর্য যখন বিকেলের দিকে গড়িয়ে যায় তখন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় লেকের চারধার। এ যেন এক মিলনমেলা মানুষের।

শকুনি লেকের সৌন্দর্য বর্ধন কাজ শেষ হওয়ায় মাদারীপুর জেলার প্রধান বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে লেকটি। দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মাদারীপুরবাসীর। প্রতিদিন লেকটির চারপাশ ঘুরে দেখতে ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। বিকেল হলে যেন মানুষের মেলা বসে লেকের পাশজুড়ে। 

সন্ধ্যা নামলে এক ভিন্ন আবহ তৈরি হয় লেকের চারপাশে। নানা রংয়ের আলোর প্রতিফলন। তখন লেকের পানিতে বাতাসের মৃদু ঢেউয়ে দোল খায়। আর স্বপ্নচারী মানুষ ভাবনার জগতে ডুবে থাকে লেকের জলের মৃদু ঢেউয়ের ছন্দে।

শকুনি লেকটি ঘুরে দেখা গেছে, শহরের বিনোদন প্রেমীদের একমাত্র ভরসা ‘শকুনি লেক’। সকাল কিংবা বিকেল একটু বিনোদনের আশায় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকেই ছুটে আসেন শহরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা শকুনি লেকের পাড়ে। এখানে আসলেই দর্শনার্থীরা নিতে পারে মুক্ত নিশ্বাস। আবার লেকটিতে প্রবেশ পথ উন্মুক্ত হওয়াতে সবার কাছেই যেন শকুনী লেকটি একটি ভালোবাসার প্রতীক।

শকুনী লেক

স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কৃত্রিমভাবে এই লেক সৃষ্টি করা হলেও সময়ের ব্যবধানে নিজে নিজেই সেখানে ফুটে উঠছে প্রাকৃতিক চিত্র। মাদারীপুর শহরের মাঝামাঝি শকুনি নামক এলাকায় ২০ একর জমির ওপর চল্লিশ দশকের দিকে লেকটি খনন করা হয়। পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙ্গাগড়ার খেলায় যখন মাদারীপুর শহরের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে তখনই ঐতিহাসিক এ শহরকে তৃতীয়বারের মতো রক্ষা করার লক্ষ্যে ১৯৪৩ সালে খনন করা হয়।

চল্লিশের দশকে এ অঞ্চলে মাটিকাটা শ্রমিকের অভাব থাকায় ২০ একর আয়তনের এই লেক খনন করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চল থেকে দুই হাজার শ্রমিক ভাড়া করে আনে। বিপুল সংখ্যক বিদেশী শ্রমিক এক টানা কাজ করে প্রায় ৯ মাসে এর খনন কাজ সম্পূর্ণ করে।

জনশ্রুতি রয়েছে, ‘প্রায় ২০০ বছর পূর্বে এই লেকের স্থানে ছিল একটি ডোবার মতো পুকুর। সেই পুকুরে বাস করতো শকুন আকৃতির কিছু ভূত। ধীরে ধীরে এই লেকটি বড় হতে থাকে। আপনাআপনিই ডোবা থেকে পুকুরে পরিনত হয়। তবে পরবর্তীতে এটা খনন করে আরো বড় করা হয়। সে সময় ভূতের ভয়ে কেউ একা লেকপাড়ে আসতো না। সেই থেকে এই লেকের নাম হয়েছে শকুনি লেক।’ তবে এই জনশ্রুতির কোন ভিত্তি নেই আধুনিক মানুষের কাছে।

তবে মাদারীপুর পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, ১৮৫৪ সালে  এই শকুনি লেকটি খননের মধ্য দিয়ে মাদারীপুর শহরের পত্তন হয়। এবং দীর্ঘদিন অযত্ন আর অবহেলায় লেকটি পড়ে থাকলেও ২০১৩ সালে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে এর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু করে মাদারীপুর পৌরসভা। 

এ বছর মার্চ মাসের শেষের দিকে এর সৌন্দয বর্ধনের কাজ শেষও হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে ‘শকুনী লেক’ প্রকল্পে ঘিরে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল, শহীদ কানন, শিশু পার্ক, স্বাধীনতা অঙ্গন, এমপি থিয়েটার মঞ্চ, শান্তি ঘাটলা, পানাহারসহ মাদারীপুর ঘড়ি নামে একটি টাওয়ার। যার প্রতি বছরে এই শকুনী লেকটির রক্ষনাবেক্ষন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ লক্ষ টাকা।

আর উন্মুক্ত এই শকুনি লেক দেখতে প্রতিদিন ছুটে আসছেন দর্শনার্থীরা। এদের কেউ বা আড্ডা দিয়ে অবসর সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বন্ধুদের সাথে সেলফি তুলতে ব্যস্ত।

লেকের চারপাশ ঘিরে থাকা পিচঢালা পথে প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হন বিভিন্ন বয়সীরা। ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত বা স্বাস্থ্য বেড়ে যাওয়া মানুষের হাঁটা বা দৌড়ানোর এক আদর্শ স্থানে পরিনত হয়েছে এই শকুনী লেক।

শকুনী লেক

লেকটিতে ঘুরতে আসা এক দর্শনার্থীরা জানান, ‘মনের প্রশান্তির জন্য এই শকুনি লেকের পাড়ে আসি। এখানে আসলে এক ভিন্ন রকম শান্তি অনুভব করা যায়। এখানকার পরিবেশটাও চমৎকার।’

জেলার শিবচর উপজেলা থেকে আসা এক দর্শনার্থী ফররুখ আহমেদ বলেন,‘শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই লেকটি এক প্রশান্তির জায়গা। এখানে আসলে ক্লান্তির অবসান ঘটে যেন। আর রাতের লেক তো অসাধারণ সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। মূলত লেকের সৌন্দর্য দেখতেই এতদূর থেকে আসা।’

মাদারীপুর পৌরসভার মেয়র খালিদ হোসেন ইয়াদ জানান, ‘লেকটি শুধু মাদারীপুরবাসীর চিত্ত বিনোদনের জন্য নয়, জেলাকে পর্যটন শহর হিসেবে রূপান্তর করতে এই লেকের গুরুত্ব ব্যাপক।’

গো নিউজ২৪/পিআর


 

পর্যটন বিভাগের আরো খবর