সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী


বোরহান বিশ্বাস প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২১, ১১:০১ এএম
সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৯ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক সোহেল রানা ও কোহিনুর আক্তার সুচন্দা। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে সোহেল রানা সশরীরে উপস্থিত থাকলেও থাকতে পারেননি জহির রায়হানের সহধর্মিণী ও জীবন থেকে নেয়াখ্যাত অভিনেত্রী সুচন্দা। তার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন মেয়ে লিসা ও ছেলে তপু রায়হান। নিজে উপস্থিত হতে পারেননি বলে ছেলে ও মেয়ের হাতে সুচন্দা একটি চিঠি দিয়েছিলেন। যেখানে আজীবন সম্মাননা পাওয়া প্রসঙ্গে তার অনুভূতি ও ভাবনার কথা তিনি লিখেছিলেন। কথা ছিল তার অনুপস্থিতি সংবলিত ওই চিঠি পাঠ করে শোনানো হবে প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। বলা হয়েছে, অনুষ্ঠানে সময় স্বল্পতার কারণে চিঠিটি পাঠের সুযোগ হয়নি।

এমন ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই কষ্ট পেয়েছেন সদ্য ওপেন হার্ট সার্জারি করানো এই জ্যেষ্ঠ অভিনেত্রী। এ ঘটনায় তিনি ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, ‘তার অনুভূতি পাঠ করা হলো না। তিনি কেনো অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন না সেটি জানতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী। জানতে পারেননি দর্শকরাও। বিষয়টি তাকে কষ্ট দিয়েছে। তিনি বলেছেন, একটু কি সময় দেয়া যেত না অনুভূতি পড়ে শোনানোর জন্য!’

এমন ঘটনা মেনে নিতে পারেননি তার ছোট বোন অভিনেত্রী ববিতাও। তিনি নিজেও এবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পাননি। ববিতা ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকেই আজীবন সম্মাননা (২০১৬ সাল) পুরস্কার নিয়েছেন। অথচ তার বড় বোন হয়েও সুচন্দা সেই পুরস্কার পেলেন এ বছর। বোনের সঙ্গে আয়োজকদের এমন আচরণ তিনিও মেনে নিতে পারেননি।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতার আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার বড় বোন এবার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পাচ্ছে, আমি অপেক্ষায় ছিলাম অনুষ্ঠানে যাব। কিন্তু আমাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণই জানানো হলো না।’ ববিতা বলেন, ‘ভুল হতেই পারে, কিন্তু আমি ৭০টির বেশি দেশি-বিদেশি পুরস্কার পেয়েছি। আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। আমি যদি আমন্ত্রণ না পাই, তাহলে নিশ্চয়ই এমন ভুল আরও হয়েছে। আমার বড় বোনের এটা আরও আগেই পাওয়া উচিত ছিল।’

প্রিয় অভিনত্রী সুচন্দার অভিযোগ একেবারে অমূলক নয়। আজীবন সম্মানা পাওয়া শ্রদ্ধেয় অভিনেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে তার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর উপদেশ শিরোধার্য মেনে তিনি কিভাবে চলচ্চিত্রেই থেকে গিয়েছিলেন তার মুখে সে কথা শুনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা সুচন্দার চিঠিটি পাঠ করা হলে খুব বেশি সময় বোধহয় নষ্ট হতো না। দর্শকরা অনুষ্ঠানে ভিন্ন ধরণের স্বাদও পেতেন। তাছাড়া, তিনি (সুচন্দা) আয়োজকদের তার লেখা চিঠিটি আগে বেশ কয়েকবার দেখিয়ে নিয়েছেন। আয়োজকদের পরামর্শ ছিল এক পাতার মধ্যে সেটি শেষ করার। সেভাবেই সুচন্দা লেখাটি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক সেটি আর পঠিত হয়নি।
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান নিয়ে ফিবছর কোনো না কোনো মুখরোচক ঘটনা ঘটেই থাকে। জাতীয় পর্যায়ে এমন বড় আয়োজনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে। এজন্য আরও ডাইন্যামিক ভাবনা ও ত্বরিত সিদ্ধান্তের দিকে দৃষ্টি দেয়া উচিত আয়োজকদের। আমরা বিদেশি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান দেখে আপ্লুত হই। কিন্তু সেই মতো আমাদের অনুষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারি না। কোথায় যেন একটা গলদ থেকেই যায়!

অনেকে বলে থাকেন, ১৯৬০, ৭০, ৮০ দশকে উন্মাদনা সৃষ্টিকারি চলচ্চিত্রের মৃত্যু ঘটেছে ১৯৯৬ সালের ৬ জুন সালমান শাহ’র মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এর পর দর্শক আর হলমুখি হয়নি তেমনটা। ফলে, এ ব্যবসায় ধস নামায় দেশের ঐতিহ্যবাহী অনেক হল এক এক করে ভেঙে ফেলেছেন মালিকরা। সেখানে অন্য ব্যবসা নিয়ে এসেছেন। কোনো কোনো হল মালিক ডিজিটাল হল গড়ার স্বপ্ন দেখেন এখনো। তবে, কেবলমাত্র ডিজিটাল হলই যে দর্শকদের হলে ফেরাতে পারবে এমনটা মনে করেন না সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করেন, চলচ্চিত্র সম্পর্কিত সবকিছুতেই পরিবর্তন আনতে হবে। শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। যোগ্য মানুষকে যথার্থ সম্মান দিতে হবে।

১৯৮৯ সালে সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যবসাসফল ছায়াছবি। চলচ্চিত্রটির সফলতায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এটি পুনর্নির্মাণ করে মুক্তি দেয়া হয়। ওই সময় দেশের ১২০০’র বেশি হলে ঘুরে ঘুরে সিনেমাটি চলেছে। হলের সেই সংখ্যা এখন ৩০০’র নিচে।

বাঘা বাঘা চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রী হারিয়ে আজ বাংলা চলচ্চিত্রের ভান্ডার প্রায় শূন্য। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জায়গা দখল করেছে ডিজিটাল চলচ্চিত্র। প্রামাণ্য অনুষ্ঠান কিংবা টেলিফিল্ম নির্মাতারা এখন চলচ্চিত্র তৈরি করছেন। নিয়ম বদলে তিন ঘন্টার ছবি দু’ঘন্টা কিংবা তারও আগে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যে নির্মাণের সঙ্গে দেশের প্রবীণ চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতাদের অনেকেই একমত নন।

চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন থাকলেও তারা নিজেদের মধ্যে দলাদলিতেই ব্যস্ত থাকেন। চৈত্র দিনের দুপুরের মতো এফডিসির ফ্লোরগুলো এখন খা খা করে। চলচ্চিত্রের দৈন্যদশা সবার সামনে দৃশ্যমান। সরকার সহযোগিতা করে উদার হস্তে। কিন্তু ফলাফল বরাবরই হতাশাব্যঞ্জক। বিশেষ সময় ছাড়া কেউ এফডিসির দিকে পা মাড়ান না। প্রশাসন চালানো থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ, অভিনয়- নাটকের মানুষদের দিয়েই কোনো কোনো ক্ষেত্রে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ক্ষেত্রে এখন বড় পর্দার পাশাপাশি ছোট পর্দার মানুষদেরও আধিক্য দেখা যায়। চলচ্চিত্রের ভালোমন্দ দেখার জন্য নাটক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্বদেরও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে দেখেছি আমরা! তবে, প্রশাসন এবং অভিনয়ে তাদের কেউ কেউ ভালো করেছেন, করছেন। এটি তাদের যেমন যোগ্যতা, তেমনি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের দেউলিয়াত্বও প্রকাশ করে।

চলচ্চিত্রের উপযুক্ত মানুষ খুঁজে না পাওয়াতেই কি এবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে জনপ্রিয় টিভি অভিনেতা আনিছুর রহমান মিলন ও অভিনেত্রী আশনা হাবিব ভাবনাকে বেছে নেয়া হয়েছিল? তাদেরকেই কেনো সঞ্চালকের দায়িত্ব দেয়া হল বিষয়টি বোধগম্য হচ্ছে না। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কেউ হলে বোধহয় বিষয়টি বেশি যুৎসই হতো। অনেকের মতে, বাংলা চলচ্চিত্র যেখানে তার জৌলুশ হারিয়েছে সেখানে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে সাধারণ দর্শকদের আগ্রহে ভাটা পড়াটা অস্বাভাবিক নয়।

চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ‘পরিবারকে নিয়ে দেখা যায়’ এমন ছবি তৈরি করতে নির্মাতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রের শিল্পী, কলা-কুশলীদের খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন। সেই আস্থার জায়গা থেকেই সুচন্দা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছিলেন। সর্বশেষ ওই ঘটনার জন্য আয়োজকদের পক্ষ থেকে কোনো রকম দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে কিনা জানি না। তবে, এমনটি কেনো হলো তা অবশ্যই তদন্তের দাবি রাখে।

দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ‘সংশপ্তক’ নাটকের মালুখ্যাত মঞ্চ ও টিভির এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা মুজিবুর রহমান দিলু সম্প্রতি মারা যান। তার ছোট ছেলে অতুল রহমান দেশের বাইরে থাকায় বাবার দাফনে অংশ নিতে পারেননি। সেজন্য তিনি একটি ভয়েস রেকর্ড পাঠান, যা পড়ে শোনান বড় ছেলে অয়ন রহমান। এটি খুব সাধারণ একটি ঘটনা। কিন্তু সেটি যদি সবাইকে শোনানোর সময় কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত হতো তা নিশ্চয়ই ন্যায়সঙ্গত হতো না।

বাংলা চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের অনবদ্য সৃষ্টি ‘জীবন থেকে নেয়া’ তাকে মর্যাদার সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে রাখবে। এমন ছবি হাজার বার দেখলেও সাধ মেটার নয়। তেমনি ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রের প্রযোজক ও নির্মাতা সুচন্দাকেও আমাদের শ্রদ্ধা ও মূল্যায়ন করতে হবে সেই ৬৯’র উত্তাল দিনে নির্মিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা হিসেবে। যিনি ৭০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।    

লেখক: সাংবাদিক

মতামত বিভাগের আরো খবর