করোনার চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা ও সফলতা


ডাঃ মোঃ আব্দুল আহাদ খান প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২০, ০৬:৪৪ পিএম
করোনার চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা ও সফলতা

করোনাভাইরাস (কভিড-১৯) বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এক মহা আতংকের নাম।  পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মহামারি দ্বিতীয়টি ছিলো না। পুরো পৃথিবী আজ থমকে গিয়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে। উন্নত বিশ্ব বলতে যাদের বুঝানো হয় সেই আমেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি জার্মানি, ফান্স, চীন, ভারত বর্তমানে করোনার থাবায় বিপর্যস্ত। আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশও বাদ যায়নি এ ভাইরাসের আক্রমণ থেকে।

আমাদের প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ, মৃত্যু ৪ লাখের উপরে। বাংলাদেশে সেই সংখ্যাটা ৮১ হাজারের উপরে, মৃত্যুও ১ হাজারের উপরে। চীন থেকে শুরু হওয়া এই ভাইরাস এখন ডিএনএ পরিবর্তন করে নতুন নতুন লক্ষণ প্রকাশ করে ছড়িয়ে পরছে বিপজ্জনকভাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার মতে করোনাভাইরাসের নির্দিষ্ট কোনো মেডিসিন বা ভ্যাক্সিন আবিস্কৃত হয়নি।

তারা বলেছে যেহেতু নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই সেজন্য চিকিৎসা করতে হবে লক্ষণ সমষ্টির ভিত্তিতে। আমেরিকা ব্রিটেন অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ অনেক মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল দিয়েছে, চেষ্টা চলছে যত দ্রুত ভ্যাক্সিন বের করা যায়। ইতোমধ্যে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন, রেমডিসিভির, ইভারমেক্টিনসহ আরো অনেকগুলি মেডিসিনকে করোনার মেডিসিন হিসেবে ভাবা হয়েছে কিন্ত সেগুলোও স্পেসিফিক নয়। এলোপ্যাথি চিকিৎসা করতে হচ্ছে তাও সেই লক্ষণের ভিত্তিতেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রেসিডেন্ট তেদরোস আধানম সতর্ক করে বলেছেন, কভিড-১৯ চিকিৎসায় যেন এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা না হয়। কারণ ভাইরাসজনিত রোগে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে। 

এমতাবস্থায় প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে হোমিওপ্যাথি। কারণ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মূলনীতি হচ্ছে লক্ষণ সমষ্টি ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যকরনের মাধ্যমে ওষুধ নির্ধারণ। হোমিওপ্যাথির মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাতে করে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য রোগজ কারণ নির্মূল করা যায়। বডির ডিফেন্স সিস্টেম যদি শক্তিশালী হয় তাহলে কোনো রোগ শরীরে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে না, আক্রমণ করলেও সেটা হয় মৃদু আকারে। 

ইতিহাস থেকে দেখা যায়, হোমিওপ্যাথি আবিস্কৃত হওয়ার পর থেকে প্রতিটি মহামারিতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বুঝার সুবিধার্থে এলোপ্যাথির সাথে যদি তুলনামূলক হিসেব করা হয়, তাহলে দেখা যায় ১৮৩১ সালে কলেরা মহামারিতে এলোপ্যাথি চিকিৎসায় মৃত্যুহার ছিল ৪০% সেখানে হোমিওপ্যাথিতে ৯%। ১৮৫৪ সালের লন্ডনের কলেরাতে যথাক্রমে ৫৯% ও ৯%।  ১৮৫৫ সালের রিও কলেরায় ৪০% ও ২%।

১৮৬২ সালের ডিপথেরিয়ায়  ৮৩.৬০% ও ১৬.৪%। ১৮৮৬ সালের ইয়েলো ফেভারে যথাক্রমে ১৫.৫% ও ৬%। এছাড়াও ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে হারটা ২৮.২% এবং ১.০৫%। অতীতের এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয় হোমিওপ্যাথি কতটা কার্যকর ছিল।

কভিড- ১৯ এর চিকিৎসা আমেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি, ভারত, বাংলাদেশ, কিউবাসহ অনেক দেশেই হচ্ছে। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সেটা অত্যন্ত সীমিত পরিসরে। আমেরিকান ইন্সটিটিউট অফ হোমিওপ্যাথির প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড ডাব্লিউ ডাসকিন (এমডি) বলেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পরিসর বাড়ালে কভিড-১৯ এ মৃত্যুহার কমে যাবে। আমেরিকান ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (FDA) কভিড চিকিৎসার জন্য হোমিওপ্যাথিকে বিবেচনা করছে।

কানাডার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ আন্দ্রে সেইন বলেছেন, হোমিওপ্যাথির মাধ্যমেই সম্ভব করোনার মৃত্যুহার কমানো। বর্তমান বিশ্বের হোমিওপ্যাথির পাইওনিয়ার জর্জ ভিথোলকাসও জোর দিয়েছেন কভিড-১৯ এ লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসায়।  বর্তমানে হোমিওপ্যাথির ভূমিকা প্রবল সম্ভাবনা জাগাচ্ছে করোনা চিকিৎসায়। ইতালির একদল চিকিৎসক ৫০ জন কভিড পজিটিভ রোগীদের টেলিচিকিৎসার একটি ডাটা তুলে ধরেছেন, সেখানে বলা হয়েছে যারা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের কাউকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি এবং তাদের সবারই পরবর্তীতে কভিড-১৯ নেগেটিভ হয়েছে।

ইতালির বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ম্যাসিমো ম্যাংগিয়ালাভোরি অনেক পজিটিভ রোগীর চিকিৎসা করেছেন যাদের প্রায় সবাই পরবর্তীতে নেগেটিভ হয়েছেন। উল্লেখ্য, তারা দুইভাবে হোমিও চিকিৎসা দিয়েছেন। ইমিউন বুস্টার বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী প্রোফাইল্যাকটিক হিসেবে এবং আক্রান্তদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসার মাধ্যমে। ভারতের আয়ুশ (Ayush) মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় গুজরাটে প্রায় ৭৭ লক্ষ মানুষকে ইমিউন বুস্টার হিসেবে মেডিসিন দেয়া হয় এতে অভাবনীয় ফল মেলে। তাদের রিসার্চে দেখা গিয়েছে চিকিৎসা নিয়েছেন কিন্ত পরবর্তীতে পজিটিভ হয়েছে এদের সংখ্যা মাত্র ১১ জন!

এছাড়াও কেরালাতে ৫০ হাজারের অধিক মানুষকে ইমিউন বুস্টার মেডিসিন দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কারোই করোনা পজিটিভ হয়নি।আগ্রার নৈমিনাথ হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের একদল চিকিৎসক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অংশ হিসেবে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR) এর গাইডলাইন অনুযায়ী অনেক মানুষকে ইমিউন বুস্টার হোমিও প্রোফাইল্যাক্সিস প্রয়োগ করেন। এবং আক্রান্তদের লক্ষনভিত্তিক চিকিৎসা দেন, নৈমিনাথ মেডিকেলের হোমিওপ্যাথ রাকেশ রাই এবং অধ্যক্ষ প্রদীপ গুপ্তা বলেন মেডিসিন প্রয়োগ করার পর পরবর্তী রিপোর্টে তারা সবাই নেগেটিভ হয়েছেন এবং যাদের রোগ প্রতিরোধের জন্য দেয়া হয় তাদের কেউই নতুন করে আক্রান্ত হননি। ভারতের স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাঃ রাজন সংকরন তার মেডিকেল টিমের মাধ্যমে ইরানে সফলভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দেন সেখানেও সাফল্য প্রায় শতভাগ। 
 
ভারতের বিখ্যাত এলোপ্যাথিক এমবিবিএস চিকিৎসক ডাঃ জশয়ান্ত পাতিল ইমিউন বুস্টার হিসেবে হোমিওপ্যাথিক মেডিসিনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। পাকিস্তান এবং কিউবা সরকারও সরকারিভাবে কভিড -১৯ এ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার অনুমতি দিয়েছে। এসব দেশেও সফলভাবে চলছে চিকিৎসা। 

বাংলাদেশে কভিড-১৯ এ হোমিওপ্যাথির সাফল্যটা শুরু হয় সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতাল রাজারবাগে। সেখানে একজন হোমিওপ্যাথকে নিয়োগ দেয়া হয় কভিড চিকিৎসার জন্য। তিনি রোগীদেরকে দুই ধাপে চিকিৎসা দেন। প্রথম ধাপে যারা আক্রান্ত হননি তাদের ইমিউন বুস্টার হোমিও প্রোফাইল্যাক্সিস দেন ১ হাজারের উপরে মানুষকে। দ্বিতীয় ধাপে ৫০ জন কভিড-১৯ আক্রান্ত পজিটিভ রোগীর লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা শুরু করেন যাদের চিকিৎসা শুরুর ৫-৭ দিনের মধ্যে ৪৯ জনের নেগেটিভ রিপোর্ট আসে! ইমিউন বুস্টার হিসেবে যাদের দেয়া হয়েছে এখন পর্যন্ত কারো পজিটিভ আসেনি।

এরই প্রেক্ষিতে পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যেন সারা দেশের প্রতিজন পুলিশ সদস্য হোমিও প্রোফাইল্যাকটিক ইমিউন বুস্টার গ্রহণ করেন। তার কিছুদিন পূর্বে ইসকনের ৩৬ জন পুরোহিত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ৫-৭ দিনের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেন। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (AMC), সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ মিরপুর, বঙ্গবন্ধু হোমিওপ্যাথিক বিশ্ববিদ্যালয় (প্রস্তাবিত) এবং বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সারাদেশেই হোমিওপ্যাথি ইমিউন বুস্টার দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।

সারাদেশেই বিভিন্ন হোমিওপ্যাথিক সংগঠন, ডাক্তার, মেডিকেল কলেজ সহ অনেকেই ফ্রি ক্যাম্প করছেন ইমিউন বুস্টার দিচ্ছেন। কিন্ত সরকারিভাবে পর্যাপ্ত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নিয়োগ না থাকায় রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথরা টেলিমেডিসিন সেবা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। টেলিফোনে চিকিৎসা সত্ত্বেও অনেক কভিড-১৯ রোগী সুস্থ হয়েছেন এবং এভাবেই চিকিৎসা চলছে সারাদেশে। সেক্ষেত্রেও সফলতার হার ঈর্ষণীয়। দেশের একমাত্র সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ মিরপুরেও খোলা হয়েছে আইসোলেশন ইউনিট। সরকারিভাবে পর্যাপ্ত নিয়োগ না থাকায় আমাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা চিকিৎসা সেবা দিতে পারছি না। আমরা হোমিওপ্যাথরা সম্মুখ করোনা যোদ্ধা হতে চাই, আমরা আত্ববিশ্বাসী আমরা পারব মৃত্যুহার কমিয়ে সফলতা দেখাতে। 

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন অল্টারনেটিভ সিস্টেমের উন্নতি ঘটিয়ে মূল ধারায় আনতে হবে। তিনি হোমিওপ্যাথিসহ অল্টারনেটিভ সিস্টেমকে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে নির্বাচনী ইশতেহারেও এটা বলেছিলেন। হোমিওপ্যাথিক সমাজের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হয়ে যাবে, যদি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এইক্ষেত্রে একটু সদয় দৃষ্টি দেন হোমিওপ্যাথিসহ অল্টারনেটিভ সিস্টেমের প্রতি।

এলোপ্যাথির পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নিয়োগের মাধ্যমে আমাদেরকেও কভিড-১৯ চিকিৎসার  সুযোগ করে দেয়া হোক। আমাদেরকে এই সুযোগ দেয়া হলে আমরা প্রমাণ করতে সমর্থ হবো কভিড-১৯ এ হোমিওপ্যাথি কতটা কার্যকর। ইমিউনোলজির জনক Emil Adolf Von Behring যিনি ডিপথেরিয়া এন্টিটক্সিন আবিষ্কারের জন্য ১৯০১ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনিও হোমিওপ্যাথি নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। লক্ষণ ভিত্তিক চিকিৎসা নিয়ে তিনি বলেন, চিকিৎসা শুরু করার জন্য রোগীর লক্ষণাবলীকে গুরুত্ব দেয়ার দিক থেকে হোমিওপ্যাথির জনক স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের থিওরিই সঠিক ছিল। একজন নোবেল বিজয়ী ইমিউনোলজিস্ট ও হোমিওপ্যাথিক সিস্টেম অফ মেডিসিনকে সঠিক বলেছিলেন।

সুতরাং এখন আর বিতর্কের সময় নেই হোমিওপ্যাথি সায়েন্স না প্লাসিবো, কাজ করে নাকি করেনা। কারণ মানবতা যেখানে বিপর্যস্ত, যেকোন উপায়ে মানুষের জীবন রক্ষাই সেখানে মূখ্য।

লেখক : বি,এইচ,এম,এস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), অনার্সসহ ১ম স্থান, সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ, মিরপুর।

গোনিউজ২৪/এন

মতামত বিভাগের আরো খবর