প্রবাসীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার শেখাতে প্রশিক্ষণ শুরুই হয়নি


নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২১, ১০:৫০ এএম
প্রবাসীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার শেখাতে প্রশিক্ষণ শুরুই হয়নি

প্রবাসীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার (শোভন আচরণ) শেখাতে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি কর্মী-স্টাফদের প্রশিক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সবেমাত্র বিমানবন্দরে দায়িত্বরত সংস্থাগুলোকে নিজ নিজ দফতরের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়বিষয়ক স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বিমানবন্দরে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে ও বিদেশ গমনে দালালদের প্রভাব কমাতে বেশকিছু নির্দেশনা দেন তিনি। প্রথম নির্দেশনাই ছিল-বিমানবন্দরে কর্মরত সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কর্মী এবং স্টাফদের অভিবাসী কর্মী ব্যবস্থাপনা ও তাদের প্রতি শোভন আচরণের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর বিমানবন্দর সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণে তৎক্ষণাৎ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দীর্ঘ ১৬ মাস পর ৪ জানুয়ারি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোসহ (বিএমইটি) আরও বেশকিছু সংস্থাকে চিঠি দিয়ে ৩ দিনব্যাপী ‘বিশেষ’ প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতি মাসে প্রশিক্ষণের হালনাগাদ তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে।

চিঠি পাঠানো একাধিক দপ্তরে যোগাযোগ করে জানা গেছে, এর আগে প্রবাসী মন্ত্রণালয় থেকে কর্মীদের প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত কোনো চিঠি দেওয়া হয়নি। এবারই প্রথম এ ধরনের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া শোভন আচরণ শেখাতে কী ধরনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে বা প্রশিক্ষণ মডিউল কেমন হবে তার বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। প্রবাসী কল্যাণ সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনকে ফোন করে এ বিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে এসএমএস করে জানতে চাইলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

অবশ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ অনুবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রথম স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের সচিব অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে স্টিয়ারিং কমিটির নির্দেশনা বাস্তবায়নে অনুবিভাগগুলোর দায়িত্ব পুনঃবণ্টন করে দেন। প্রশিক্ষণ অনুবিভাগকে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আগে এ দায়িত্ব ছিল কল্যাণ শাখার। প্রশিক্ষণ শাখা দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই সব দপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেন, ভদ্র ব্যবহার বা শোভন আচরণ শেখাতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার নির্দেশনার বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। কোনো সংস্থা থেকে তাদের কিছু জানানো হয়নি। তাছাড়া প্রশিক্ষণ কীভাবে দেওয়া হবে, কী কী বিষয় শেখানো হবে তার গাইডলাইন থাকতে হবে। কারণ বিমানবন্দরে কর্মরত প্রত্যেক কাস্টমস কর্মকর্তাকে প্রবাসীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রবাসীরা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হয়ারানির অভিযোগ করলে তদন্তসাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০১৮ সালে চট্টগ্রামে শাহ আমানত বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিমানবন্দর ব্যবহারকারীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে টিআইবি গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক)। ওই প্রতিবেদনে হয়রানি বন্ধে ১৩ দফা সুপারিশ করা হয়।

টিআইবির গবেষণার তথ্যে উল্লেখ করা হয়, তদারকি ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে শাহ আমানত বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি যেমন রয়েছে, তেমন নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় বিদ্যমান। বিমানবন্দরে প্রবেশ থেকে শুরু করে বোর্ডিং লাউঞ্জ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে যাত্রীদের কাছ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করা হয়। প্রবেশ এবং প্রস্থানের সময় আনসার বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা যাত্রী হয়রানির ঘটনা ঘটে।

অর্থের বিনিময়ে ইমিগ্রেশন কর্মীদের একাংশ ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্নে যাত্রীদের সহায়তা করেন। কোনো কোনো যাত্রীর বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের হয়রানি এবং অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়। ভিসার মেয়াদ কম, ছবি ঠিক নেই-এসব অজুহাতে মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করা হয়।

এছাড়া যাত্রীরা অনেক সময় অনুমোদিত মুদ্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ দেশি ও বিদেশি মুদ্রা বহন করেন। এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে অনেক সময় নিরাপত্তা কর্মীরাই তা যাত্রীদের কাছ থেকে কেড়ে নেন। শুল্ক বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ অর্থের বিনিময়ে নিষিদ্ধ পণ্য বা শর্তসাপেক্ষে আমদানিযোগ্য পণ্য বিশেষ করে টিভি, সোনার বার, মোবাইল ফোন সেট ও শাড়ি বিমানবন্দর থেকে বের করে দেওয়ার সুযোগ করে দেন।

আবার অনেক ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে নিয়ে আসা পণ্যের একাংশ নানা অজুহাতে রেখে দেয় তারা। এছাড়া বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই প্রবাসীরা পড়েন সিএনজি ও মাইক্রোবাস সিন্ডিকেটের কবলে। মনিটরিং না থাকায় তারাও সিন্ডিকেট করে প্রবাসীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রবাসীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন। কিন্তু তারা যখন দেশে আসেন বিমানবন্দরে নানা হয়রানি-হেনস্তা হতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর যথার্থ নির্দেশনা দিয়েছেন। তা বাস্তবায়ন না করা মানে সরকারপ্রধানকে অবমাননার শামিল। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কাজই হচ্ছে প্রবাসীদের স্বার্থ দেখভাল করা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও কর্মী-স্টাফদের প্রশিক্ষণ না দেওয়ার অর্থ প্রবাসীদের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহারে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহ নেই। এটা প্রত্যাশিত নয়।

তিনি আরও বলেন, কেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে এত বিলম্ব সে বিষয়ে ওই ডেস্ক সংশ্লিষ্টদের কাছে জানা প্রয়োজন। একইসঙ্গে দ্রুততার সঙ্গে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মী ও স্টাফদের প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাটি জানিয়ে দেওয়া দরকার আছে বলে মনে করি।

জাতীয় বিভাগের আরো খবর