নির্যাতনের ভয়ে ১১তলা পাইপ বেয়ে নেমে আসে গৃহকর্মী শাওন


নিজস্ব প্রতিনিধি: প্রকাশিত: জুন ২১, ২০১৮, ০৩:৪১ পিএম
নির্যাতনের ভয়ে ১১তলা পাইপ বেয়ে নেমে আসে গৃহকর্মী শাওন

ঢাকা : শাওনের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার উত্তর সাহেবগঞ্জে।  সে ফরিদগঞ্জের বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় পড়তো।  তার বাবার নাম জাহাঙ্গীর হোসেন কালু।  একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় জাহাঙ্গীর তানজিলুরের দাদাকে দেখাশোনা করতো।  সেই সূত্রে শাওনকে ঢাকায় কাজ করতে পাঠায় জাহাঙ্গীর হোসেন।

শাওন গত সাত মাস ধরে রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের ১২/এ, নম্বর বাড়ির ১১ তলার ১১০২ নম্বর ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছিল।

এরপর বুধবার ( ২০ জুন) সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটের বাথরুমে প্রবেশ করে ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে প্লাস্টিকের পাইপ বেয়ে ১১ তলা থেকে নিচে নেমে আসে সে।  এলাকাবাসীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে টের পেয়ে যান গৃহকর্তা।  এসে শাওনকে গার্ডরুম আটকে মারধর শুরু করেন।  বিষয়টি টের পেয়ে স্থানীয় একজন জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ এ ফোন দিলে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন পুলিশ সদস্যরা।  আটক করা হয় মো. ইকবাল (গৃহকর্তার শ্যালক), তার স্ত্রী তামান্না খান ও তানজিলুর রহমানকে (ইকবালের ভাগ্নে ও গৃহকর্তার ছেলে)।  তবে গৃহকর্তা ও তার স্ত্রী এখনও পলাতক রয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২১ জুন) সকালে রাজধানীর রমনা থানায় সাংবাদিকদের শাওন জানায়, ওই বাসায় পাঁচজন থাকতো।  সবাই আমাকে মারধর করতো।  একবার তাদের একটি স্যুটকেসের চাবি হারিয়ে যায়।  তাদের ধারণা আমি চাবিটি চুরি করে টাকা নিয়েছি।  এজন্য কখনও আমাকে রড দিয়ে কখনও বৈদ্যুতিক ক্যাবল দিয়ে পেটাতো।  একবার ইলেক্ট্রিক সকও দেয়।  রড দিয়ে পিটিয়ে আমার পায়ের তালুও থেঁতলে দেয়া হয়।

শাওন বলে, আমাকে ঢাকায় পড়াশোনা করানোর কথা বলে আনা হয়।  কিন্তু পড়াশোনা তো দূরের কথা দিন-রাত ঘরের কাজ করতে বাধ্য করা হয়।  প্রতিদিনের বাজার থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা আমাকে দিয়ে করানো হয়নি।  কাজের বিনিময়ে আমাকে কোনো টাকা দেয়া হতো না।

একদিন দিলুরোড থেকে কাঁচাবাজার কিনে আনার পর আমাকে অনেক মারধর করা হয়।  তামান্না আমাকে বলতো, গত সপ্তাহে কম দামে তরকারি এনেছিস, এবার বেশি কেন? বল কত টাকা মারছস?

শাওন জানায়, এরপর একদিন তাদের একটি স্যুটকেসের চাবি হারিয়ে যায়।  স্যুটকেসে নাকি অনেক টাকা ছিল।  ইকবালের ধারণা, আমি চাবি চুরি করেছি।  তাই আমাকে চিকন রড দিয়ে মারধর করে।  তার ভাগ্নে তানজিলুর ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরি করছে।  সেও এই কথা শুনে বাড়ি ফিরে আমাকে অনেক মারে।  চাবি হারানোর পর একদিন বলে, ১০ হাজার টাকা পাচ্ছে না, আরেকদিন বলে ২০ হাজার টাকা পাচ্ছে না।  প্রতিদিনই আমাকে টাকার জন্য মারধর করতো।  ইকবাল একদিন সবাইকে ডেকে আমাকে ইলেক্ট্রিক সক দেয়।  টাকা চুরির কথা স্বীকার না করলে আবার সক দেয়ার হুমকি দেয়।  আমি ভয়ে বলি যে, আমিই টাকা চুরি করেছি।  ওই ঘটনার কয়েকদিন পর ইকবাল নিজেই স্যুটকেসের চাবি খুঁজে পায়।  এরপর আর কিছু বলেনি।

শাওন বলে, মারধরের ওই ঘটনার পর আমি মাঝে মাঝে ফোনে বাবার সঙ্গে কিংবা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম।  তখন আমি যাতে নির্যাতনের কথা না বলতে পারি সেজন্য সবসময় আমার সামনে বসে থাকতো তানজিলুর।  একদিন ফোনে কথা বলার আগে ছুরি এনে আমার গলায় ধরে রাখে।  আমি যদি ফোনে মারধরের বিষয় বাড়িতে জানাই তাহলে আমাকে হত্যা করবে বলে হুমকি দেয়।  আমি ভয়ে বাড়িতে কিছুই বলিনি।  রোজার শেষের দিকে তারা আমার বিরুদ্ধে আড়াই লাখ টাকা চুরির অভিযোগ আনে।  যদিও আমি চুরি করিনি।  ২০ জুনের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে না দিলে আমাকে মারধর করবে আর বাবাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে তারা হুমকি দেয়।  ওই ভয়ে আমি বাথরুম থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নামি।

পাইপ বেয়ে নিচে নামার সময় ভয় লাগেনি- জানতে চাইলে শাওন বলে, ছোটকালে গাছে উঠতাম।  একটু অভ্যাস ছিল, ভয়ও লেগেছে।  কিন্তু পাইপ বেয়ে না নামলে রাতে আমাকে অনেক অত্যাচার করা হতো।  তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নেই। 

রমনা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোশাররফ হোসেন বলেন, আমি তাকে উদ্ধার করতে গেলে তারা আমাকে ভুল তথ্য দেয়।  নির্যাতনের শিকার শিশুকে চোর বলে আটকে রাখে।  পরে বাড়িতে থাকা তিনজনকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা মারধরের কথা স্বীকার করে।

শিশুটির হাতে-পায়ে, পায়ের তালুতে ও পিঠে নির্যাতনের দাগ রয়েছে।  তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হবে বলেও জানান এসআই মোশাররফ।


গো নিউজ২৪/আই

জাতীয় বিভাগের আরো খবর