কোরবানির পশু জবাইসংক্রান্ত জরুরি মাসায়েল


ইসলাম প্রকাশিত: জুলাই ১৫, ২০২১, ১১:০৬ এএম
কোরবানির পশু জবাইসংক্রান্ত জরুরি মাসায়েল

কোরবানির ঈদ। মুসলমানদের আনন্দের দিন। ত্যাগ ও মহিমার দিন। এ দিনে জ্ঞানী, সামর্থ্যবান, সাবালক, মুকিম প্রতিটি মুসলিমের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহর সন্তুটিই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার পবিত্র হাদিসে এরশাদ করেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কোরবানি করে না, তারা যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। [সূত্র: সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৩।]

কোরবানির সময় মোট তিন দিন। ১০, ১১ ও ১২ই জিলহজ। ১০ই জিলহজ ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ই জিলহজ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কোরবানি করা যায়। তবে প্রথম দিন করাই অধিক উত্তম। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো কারণে এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোরবানি করতে না পারলে একটি মধ্যম মানের ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। পরবর্তী বছর কাজা কোরবানি করা জরুরি নয়। [সূত্র: ফাতাওয়া শামী: ৯/৪৫২; বাদায়ে সানায়ে: ৪/২০২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া: ৪/৩০৯।]

কোরবানির জন্য দিনের বেলাটাই অধিক উপযোগী। অযথা রাত্রি বেলা কোরবানি করা সমীচীন নয়, মাকরুহ। এতে অঙ্গহানীসহ পশুর অধিকাংশ রগ না কাটারসমূহ আশংকা বিদ্যমান রয়েছে। সেজন্য দিনের বেলা করাই শ্রেয়। তবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে রাতেও করার অবকাশ রয়েছে। [সূত্র: ফাতাওয়া শামী: ৬/৩২০; ফাতাওয়া কাজিখান: ৩/৩৪৫।]
কোরবানি একটি মহৎ ইবাদত। নিছক লৌকিকতা বা অহংকারের জন্য কোরবানি করলে তা কখনই কবুল হয় না। সেজন্য কোরবানি হওয়া চাই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে (কোরবানির) রক্ত-মাংশ কিছুই পৌঁছে না। পৌঁছে কেবল তোমাদের সদিচ্ছা-তাকওয়া।’ [সুরা হজ: ৩৭।] এজন্য কবুলিয়াতের লক্ষ্যে মনে মনে নিয়ত করা জরুরি। তবে পশু জবাই করার সময় মুখে নাম উচ্চারণ করা বা পড়ে শুনানো জরুরি নয়। [সূত্র: ফাতাওয়া শামী: ৬/৩১৫;বাদায়ে সানায়ে: ৫/৬৩-৬৪; কিফায়াতুল মুফতি: ৮/১৮৬-১৮৭।]

হাদিস শরিফে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানির কথা এসেছে। সে হিসেবে নিজ বাড়ির পালিত পশু দ্বারা কোরবানি করা চাই। তা না হলে সামর্থ্যানুযায়ী ভালো পশু কিনেও করা যাবে। আর মহব্বত ও ভালোবাসার কারণেই কোরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম। নইলে অন্তত জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকা কর্তব্য। [সূত্র: বাদায়ে সানায়ে: ৫/৭৯ ; ফাতাওয়া কাজিখান: ৩/৩৫৫।]

কোনো কারণে কোরবানির পশু নিজে জবাই করতে না পারলে সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি। কেননা জবাইকারী মুসলমান হওয়া আবশ্যক। কোনো অমুসলিম বা বিধর্মী দ্বারা জবাই করালে কোরবানি সহী হবে না। আবার জবাইয়ের সময় জবাইকারী ও তার ছুরি চালনায় সহযোগীদের বিসমিল্লাহ বলাও জরুরি। ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ না বললে কোরবানি সহী হবে না। এমনকি তার গোশত খাওয়াও বৈধ হবে না। বরং সেটি মৃত প্রাণী বলেই বিবেচিত হবে। [সূত্র: ফাতাওয়া শামী: ৬/২৯৬; আল ইখতিয়ার: ১/৫১।]

জবাইকালে ছুরিটি তীক্ষ্ম ধারালো হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভোতা বা কম ধারালো ছুরি দ্বারা জবাই করলে পশু কষ্ট পায়। সেজন্য এরূপ ছুরি দ্বারা জবাই করা মানবতাপরিপন্থী ও মাকরূহ। তেমনি পশুর কমপক্ষে তিনটি রগ (খাদ্যনালী, শ্বাসনালী ও শাহরগ দুটির যে কোনো একটি) কাটা জরুরি। নইলে কোরবানি সহী হবে না।[সূত্র: আল ইখতিয়ার: ১/৫১।]

কোরবানির সময় উটকে নহর আর গরু-মোষ, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদিকে জবাই করা মুস্তাহাব। জবাইয়ের ক্ষেত্র হলো,পশুর চোয়াল ও বুকের মাঝামাঝি স্থান-গলা । এজন্য পশুর ঘাড় বা পিঠের দিক থেকে জবাই করা মাকরুহ। এতে পশু কষ্ট পায়। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রগ কাটার আগেই প্রাণীটি মৃত্যুর আশংকা থাকে। সেজন্য গলার দিক থেকেই জবাই করা বাঞ্ছনীয়।[সূত্র: আল ইখতিয়ার: ১/৫১।]

জবাইয়ের সময় পশুর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও কোরবানি সহী হবে এবং তার গোশতও খাওয়া যাবে। তবে বিনা প্রয়োজনে এমনটা করা মাকরুহ। এতে পশুকে অযথা কষ্ট দেয়া হয়। তবে এ কারণে কোরবানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। [আল ইখতিয়ার: ৫/১২; মুখতাসারুল কুদুরী: ২৭৬।]

ঘটনাক্রমে কোরবানির দিনগুলোতে শক্তিশালী কোনো গরু-মোষের কাছে যাওয়া সম্ভব না হলে বা কূপ কিংবা খাদে পড়ে যাওয়া কোনো পশু জীবিত উঠানো সম্ভব না হলে ধারালো অস্ত্র দ্বারা দূর থেকে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করলেও তা বৈধ হবে এবং তার গোশত খাওয়া হালাল হবে। [সূত্র: আল বাহরুর রায়েক: ৮/১৭১; ফাতাওয়া শামী: ৬/৩০৩; আল ইখতিয়ার: ১/৫১।]

উন্নত বিশ্বের কোথাও কোথাও মেশিনে জবাইয়ের প্রচলন রয়েছে। কোরবানির পশু এভাবে জবাই করা সমীচীন নয়। হক্কানী ওলামায়ে কেরাম এটাকে ভালো মনে করেন না। সেজন্য এত্থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। তবে কোথাও যদি এমনটা করতেই হয় তাহলে সুইচ দাতাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে এবং বিসমিল্লাহ বলে সুইচ অন করতে হবে। নচেৎ কোরবানি সহী হবে না। তার গোশত খাওয়াও হালাল হবে না। [সূত্র: ফাতাওয়া শামী: ৯/৪২৭;আল ইখতিয়ার: ৫/৯; আপকে মাসাইল: ৪/১৩০।]

জবাইয়ের পর পশুটি নিস্তেজ হওয়ার পূর্বেই তার রগ কাটা বা চামড়া ছাড়াতে শুরু করা মানবতা বিবর্জিত ও মাকরুহ। এতে পশুর অসম্ভব কষ্ট হয়। সুতরাং নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করা জরুরি। [সূত্র: সুনানে নাসাঈ: ৪৪১৭; কিতাবুল ফাতাওয়া: ৪/১৮৮।]

মানবতার খাতিরে ঈদের দিন সবাই পরস্পরকে সহযোগিতা করে। ঈমাম সাহেব পশুটি জবাই করে দিয়ে যান। মহল্লা ও সমাজের কেউ কেউ পশুর চামড়া ছাড়াতে ও গোশত বানানোর কাজে সহযোগিতা করেন। সেজন্য তাদের প্রত্যেককেই কিছু সম্মানি দেয়া কর্তব্য। সেটা ঈদ বোনাসের নামেও হতে পারে। কেননা ঈদের দিন কাউকে দিয়ে ফ্রি শ্রম নেয়া সমীচীন নয়। তাই অন্যের মাধ্যমে জবাই করালে, সহযোগিতা নিলে তাদের যথোপযুক্ত সম্মানি দেয়া একান্ত কর্তব্য।[ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ৪/৪৫৪; কিফায়াতুল মুফতি: ৮/২৪৩।]

অথচ কাজ শেষে দেখা যায়, তাদের কাউকে মাথা, রান, ভুড়ি বা সামান্য পরিমাণ গোশত দেয়া হয়। আবার কখনো হুজুরকে চামড়া দিয়েই বিদায় করা হয়। আসলে এমনটা কাম্য নয়। এক্ষেত্রে মাসয়ালা হলো, কোরবানির কোনো অংশ পারিশ্রমিক বা বিনিময় হিসেবে দিলে সেটা বৈধ হয় না। কেননা কোরবানির পশুর কোনো অংশ বিনিময়যোগ্য নয়। তবে হাদিয়া হিসেবে দেয়া যেতে পারে। [সূত্র: ফাতাওয়া শামী: ৯/৪৭৫;বাদায়ে সানায়ে: ৫/৮১;ফাতহুল কাদির: ৮/৪৩৭।

ইসলাম বিভাগের আরো খবর