গরু জবাই নিষিদ্ধ করে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারত?


আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: আগস্ট ৯, ২০১৭, ০১:৩৫ পিএম
গরু জবাই নিষিদ্ধ করে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারত?

নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে গরু জবাই নিয়ে নিয়ে চলছে রীতিমতো লঙ্কাকাণ্ড। এ পর্যন্ত দেশটির অনেক রাজ্যেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে গরু হত্যা। হিন্দু ধর্মে গরুকে দেখা হয় দেবতা হিসাবে। আর তাই গরু জবাইয়ের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা। তবে শুধু নিষেধাজ্ঞাই শেষ কথা নয়, গো-রক্ষকরা রাস্তাঘাটও পাহারা দেন, যাতে কেউ গরু কিংবা গরুর চামড়া পর্যন্ত বহন করতে না পারে।

গরু-মহিষ নির্বিশেষে চামড়া দেখলেই তাদের নির্বিচার হামলার কারণে এখন ভারতের পরিবহন কোম্পানীগুলোও আর চামড়া বহন করতে চাইছে না। এর জের এসে পড়ছে দেশটির বৃহৎ চামড়া শিল্পের উপর। বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে এখনো কিছু চামড়া ব্যবসায়ী ক্রেতাদের কাছে নিজেদের তৈরি পণ্য তুলে ধরছেন। তেমনই একজন চামড়া ব্যবসায়ী ইমরান আহমেদ খান।

তিনি জানান, গরু নিয়ে ভারতে যে তুলকালাম চলছে তার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে দেশটির অন্যতম বড় এই শিল্পখাতে। ফলে এখন ব্যবসা ভিয়েতনামে সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবছেন ইমরান। এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারানোর ভয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। আমাদেরও ছাঁটাই করতে হবে। কর্মীদের সংখ্যা কমাতে হবে। কারণ আমরা আর ব্যবসা চালাতে পারছি না। সরকারের যে নীতি, তা এই শিল্পের জন্য ক্ষতিকর। তারা যেন এই শিল্পকে মৃত্যুসনদ দিয়ে দিয়েছে, যেখানে লাখ লাখ মানুষের রুটিরুজি রয়েছে।’

সারা ভারতে ১৬৮টি শিল্প কারখানার সঙ্গে যুক্ত গরুর মাংসের ব্যবসা। কিন্তু প্রশাসনের কড়া নিয়মের বেড়াজালে পড়ে তালা লেগেছে সেই দোকানগুলোতেও। ফলে সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়তে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট বাকি শিল্পগুলোও। এছাড়া পুরো ভারতে যে পরিমাণ চামড়াজাত দ্রব্য পাওয়া যায়, তার অর্ধেকই তৈরি হয় উত্তরপ্রদেশে। মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাবের মতো রাজ্যগুলোতেও মার খাচ্ছে চামড়া কারখানাগুলো। ২০১৫ সালে মহারাষ্ট্রে কোলাপুরি জুতার কারখানায় কর্মী ছিল কমপক্ষে ৬০০। সেখানেও কসাইখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০০ জনে।

কলকাতার যেসব বড় চামড়া কারখানা রয়েছে, সেখানে এখনো কাজ চললেও আগের তুলনায় মেশিনগুলো এখন খুবই কম ব্যবহৃত হয়। কারণ ভারতের অনেক রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর চামড়া নিয়ে যেসব ট্রাক এখানে আসছে, তার ওপরও ঘটছে হামলার ঘটনা।

হিন্দু ধর্মমতে গরু একটি পবিত্র প্রাণি

কলকাতা ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা জিয়ে নাফিস বলেন, ‘প্রতিদিনই সড়কে চামড়াবাহী গাড়ির ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে, তাই গাড়িমালিকরা আর চামড়া পরিবহন করতে চায় না। মানুষ বুঝতে চায় না, এখানে কি গরু, নাকি মহিষ, না কিসের চামড়া আছে। চামড়া দেখলেই তারা সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা মনে করে, সবই গরুর চামড়া।’

ফলে রুটি রোজগার কমে যাওয়ার আশংকায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ চলছে। এদের বেশিরভাগই চামড়া কারখানার শ্রমিক বা নিম্নপদের কর্মচারী। নিরেজ কুমার নামের এক বিক্ষোভকারী বলেন, তার মতো হাজার হাজার লোক তাদের চাকরি হারাচ্ছে। তার ভাষায়, ‘আমরা এখন বেকার বসে আছি, কিছুই করার নেই। আমরা কীভাবে আমাদের পরিবারকে খাওয়াবো? আমরা কি এখন চুরি করবো?’

২০১৪ সালেও ভারতে যে শিল্প থেকে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা লাভ আসতো, সেখান থেকে এখন ৮০০ কোটি টাকাও আসছে না। চামড়া কারখানার এক মালিক জানান, তার ৩৪ জন কর্মী প্রতি সপ্তাহে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা ও খাওয়া-দাওয়া পেতেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের বেতন দেয়াই সম্ভব হচ্ছে না।

ভারতের কাউন্সিল অব লেদার এক্সপোর্ট’র তথ্য মতে, বছরে ৩ হাজার কোটি ফুট চামড়া উৎপাদন করে দেশটি। বিশ্বের মোট গরু এবং মহিষের ২১ শতাংশ ভারতে থাকার কারণে দেশটি চামড়াজাত পণ্যের কাঁচামাল সরবরাহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতো। কাউন্সিল অব লেদার এক্সপোর্ট’র আহবায়ক তপন নন্দী বলেন, আমাদের চামড়াজাত কাঁচামাল রপ্তানি কমে গেছে। ভারতের ২ হাজার ট্যানারি সরবরাহ সংকটে ভুগছে।

এদিকে গরু জবাইয়ের বিষয়টি নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টেও উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, সাধারণ মানুষদের ওপর এসব হামলার ব্যাপারে চোখ অন্ধ করে রেখেছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। তবে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান একেবারেই পরিষ্কার। কারো এ ধরনের কর্মকাণ্ড বরদাস্ত করা হবে না। সরকার নিশ্চয়তা দিচ্ছে, যারাই এ জন্য দায়ী, তাদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখানো হবে না।’

ভারতে এখন স্বাধীনতার ৭০ বছর পালন করা হচ্ছে, কিন্তু গরু নিয়ে বির্তক যেন সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। গরু এখন যেন ভারতের পথ নির্দেশক হয়ে উঠেছে। দেশটি কোন পথে যাচ্ছে, একটি উদার দেশ, নাকি হিন্দু দেশ?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সন্দীপ রায় বলেন, ‘আমি মনে করি, ভারতে গরু যেন অন্যদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের ভিন্নতার একটি বিষয় হয়ে উঠেছে। কেউ যথেষ্ট দেশপ্রেমিক কি না- সেটা যাচাইয়ে এটা যেন খুব সহজ একটি লিটমাস টেস্ট। সত্যিকারের ভারতীয় মানে বোঝানো হচ্ছে হিন্দু ভারতীয়।’

গো নিউজ২৪/ আরএস

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর