ধর্মগুরুদের যৌনশোষণের হাতিয়ার ভারতের ‘দেবদাসী’ প্রথা


আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০১৭, ০২:০৩ পিএম
ধর্মগুরুদের যৌনশোষণের হাতিয়ার ভারতের ‘দেবদাসী’ প্রথা

বৈচিত্র্যের শেষ নেই বহু সংস্কৃতির দেশ ভারতে। মানুষের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নানা রীতি-নীতি, কু-সংস্কার আর প্রথায় পূর্ণ এই দেশটি। আর পাঁচটি প্রথার মতো ‘দেবদাসী’ প্রথাও ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতির একটি অংশ। তবে প্রাচীন হলেও দেশটির অনেক অঞ্চলে এখনও অস্তিত্ব আছে এই রীতির।

এই দেবদাসী প্রথাটি একদিকে যেমন ভারতীয়দের ধর্মীয় কু-সংস্কারের পরিচয় বহন করে, তেমনি মানবাধিকার কর্মীরা একে আখ্যায়িত করেন ‘যৌনশোষণের হাতিয়ার’ হিসেবে। হাজার বছরের প্রাচীন এই প্রথা দেশটির মানুষের ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। আর এর পেছনে আছে চরম দারিদ্র্য, বর্ণবাদ এবং জাতিবিদ্বেষী চিন্তা।

রীতি অনুসারে, গরিব ঘরের মা-বাবা তাদের কুমারী মেয়েকে ঋতুমতী হওয়ার আগেই নিয়ে আসেন মন্দিরে। প্রথমে কুমারী মেয়েদের নিলাম করা হয়। তারপর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মেয়েটিকে উৎসর্গ করার নামে দেবতার কথিত বিয়ে দেন। এরপর থেকে অন্য কোনও পুরুষ আর ওই মেয়েটির স্বামী হতে পারে না। খাওয়া-পরার বিনিময়ে সারা জীবন মন্দিরেই থাকতে হয় তাদের। মন্দিরের বিভিন্ন কাজে যেমন দৈহিক পরিশ্রম দিতে হয়, তেমনি সেখানকার প্রধান পুরোহিত থেকে শুরু করে মন্দির সংশ্লিষ্ট অন্য পুরুষদেরও যৌনতার সঙ্গী হতে হয় এসব মেয়েকে।

দেবতার সঙ্গে বিয়ে দেয়া হয় কুমারী মেয়েদের

কখনও কখনও সমাজের উচ্চ বর্গীয় ধনী কিংবা সামন্তপ্রভুদের রক্ষিতার ভূমিকা পালন করতে হয় দেবদাসীদের। মন্দিরের পূজারি ব্রাহ্মণ এবং সামন্তপ্রভুদের যোগসাজশে কৃষক ও কারুশিল্পী বা কারিগরদের ওপর ধর্মীয় প্রভাব খাটিয়ে দেবদাসীদের বেশ্যাবৃত্তিকে দেয়া হয় ধর্মীয় বৈধতা। উৎসর্গের পর দেবদাসীকে ভোগ করার প্রথম থাকে অধিকার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের।

এই সামজিক ও ধর্মীয় প্রথার উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে আছে নানা কাহিনী, বিতর্ক এবং বিভিন্ন মতবাদ। এর ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন মন্দিরের গায়ে। গুজরাটে এমন প্রায় চার হাজার মন্দিরে ছিল, যেসব জায়গায় ২০ হাজারের বেশি দেবদাসী নাচ-গান করতো। এদের নর্তকী বলেও অভিহিত করা হতো।

তাদের অতীতে বলা হতো কলাবন্তী যারা শিল্পকর্মে পারদর্শিনী। অভিজাত শ্রেণি তাদেরকে মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করত। তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল মন্দিরের মেঝে ঝাড়ু দেয়া, পবিত্র প্রদীপে তেল ঢালা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পূজামণ্ডপে ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গান-নৃত্য করা এবং পূজার সময় প্রতিমাকে বাতাস দেয়া। এ কাজের জন্য তাদেরকে মন্দিরের তহবিল এবং আয় থেকে, যা প্রদান করা হতো তা তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য অপ্রতুল ছিল। এ কারণে মাঝে মাঝে তারা ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে উঠত।

কৌটিল্য দেবদাসী প্রথা পর্যবেক্ষণের পর বলেন, দেবদাসীদের মধ্যে যারা মন্দিরে সেবিকার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে বা অব্যাহতি নিয়েছে, তাদের এবং সঙ্গে বিধবা, পঙ্গু নারী, সন্ন্যাসিনী বা ভিখারিনী, শাস্তিপণ পরিশোধে ব্যর্থ নারী, গণিকার মা এবং পশম, তুলা, শণ ইত্যাদি বাছাইর কাজে নিয়োজিত মেয়েদের মন্দির উপাধ্যক্ষগণ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করত।

দেবদাসীদের অন্যতম প্রধান কাজ নাচ-গান করা

কোনও কোনও নৃবিজ্ঞানীর মতে, গর্ভধারণ ও পুনরায় সন্তান জন্মদানের দেবীর পূজাকে ভিত্তি করে দেবদাসী শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। মানবজাতির বংশবৃদ্ধির জন্য প্রাচীন হিন্দুসমাজে একটি মেয়েকে দেবীমাতার নামে উৎসর্গ করার প্রথা চালু ছিল। বৈদিক যুগে গণিকা, বেশ্যা ইত্যাদি নানা নামের বারাঙ্গনা ছিল। মন্দির সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে আনন্দ ও বিলাসপ্রিয় নতুন নতুন দেবতারও উদ্ভব হয়। ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে নর্তকীদের নিয়োগ করা হয়। দেবতাদের আনন্দ প্রদানের জন্য সৃষ্ট এই প্রথা রাজা, শাসক ও সর্দারদের পৃষ্ঠপোষকতায় দ্রুত বিকাশ লাভ করে। ফলে ঈশ্বরের সেবা, মর্তে ঈশ্বরের প্রতিনিধিদের তথা রাজা, সম্রাট এবং ধর্মযাজকদের সেবার সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়। ভারতের রাজপুত্র, রাজা এবং জমিদারগণ দেবদাসীদের যখন থেকে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করতে শুরু করে, তখন থেকে তাদের অবস্থা একটি নতুন রূপ পরিগ্রহ করে।

অনেক দেবদাসীকে নিঃসন্তান পরিবারে নিয়োজিত করা হতো তাদের পরিবার এবং পারিবারিক সম্পত্তি বিলোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এক্ষেত্রে মেয়েদের ঈশ্বরের নিকট উৎসর্গ করে তাদেরকে উচ্চতর সম্প্রদায়ের বা অভিজাত লোকের সন্তান ধারণের জন্য যৌনমিলনের কাজে ব্যবহার করা হতো। এসব সন্তানরা পরবর্তীকালে ঠাকুরদাদার নাম ধারণ করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতো।

দেবদাসী প্রথার ব্যাপক প্রচলন হয় অষ্টম শতাব্দীতে পুন্ড্রবর্ধন নগরে। বাৎস্যায়ন তার কামসূত্র গ্রন্থে সমসাময়িক ভারতে দেবদাসীদের সম্পর্কে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। গৌড় ও বাংলার  ব্রাহ্মণ, সরকারি কর্মকর্তা, গৃহভৃত্য, ক্রীতদাস এবং দেবদাসীরা যথেচ্ছ যৌনাচারে অভ্যস্ত ছিল। পুন্ড্রবর্ধন নগরের দেবদাসীরা বিলাসী এবং কামাচারপূর্ণ জীবনযাপন করত। তাদেরকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

প্রাচীন কালের এক দেবদাসী

দেওপাড়ায় প্রাপ্ত তাম্রফলক অনুযায়ী, বিজয় সেন এবং ভট্ট ভবদেব তাদের মন্দিরে শত শত দেবদাসী নিয়োগ করেছিলেন। রামচরিতম এবং পবনদূত গ্রন্থে দেবদাসীদের জীবনযাত্রার প্রশংসাপূর্ণ বর্ণনা দেয়া আছে। এমনকি আধুনিক যুগেও ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের ইয়াল্লামা, হনুমান এবং শিবমন্দিরে আড়াই লাখ মেয়েকে নিয়োগ করা হয়। নেপালে বিশেষ করে দোতি, বাইতাদি এবং দাদেলধুরা জেলাসমূহে দেবদাসীদের এসব প্রতিষ্ঠান ছিল সনাতন প্রথা হিসেবে প্রচলিত। এসব স্থানে অবিবাহিত মেয়েদের মন্দিরের সেবিকা হিসেবে কাজ করার জন্য প্রস্তাব করা হতো। অতি সম্প্রতি সরকারের কিছু কঠোর আইন বলবৎ হওয়ায় দেবদাসীর প্রথা বিলোপ্তির পথে।

ইতিহাসবিদ রমেশ মজুমদার এবং ইউ এন ঘোষালের মতে, মধ্যযুগে গরিব ঘরের নীচু জাতির মেয়েদের শোষণের উৎস ছিল এই দেবদাসী প্রথা। সে সময় দেবদাসীদের সংখ্যা ছিল সবথেকে বেশি, যার সিংহভাগ ছিল দক্ষিণ ভারতে। অনেকের মতে, ভারতে দেবদাসী প্রথার প্রচলন হয় বৌদ্ধধর্মের পতনের সঙ্গে। বৌদ্ধমঠগুলির বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনীরাই বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু মন্দিরের দেবদাসী হয়ে ওঠে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। কারণ প্রাচীন ভারতীয় ধর্মশাস্ত্র যেমন জাতক, কৌটিল্য কিংবা বাৎসায়নের কামশাস্ত্রে দেবদাসীর কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না।

ভারতের ধর্মশাস্ত্রবিদ যোগাশঙ্কর এই প্রথার বিবর্তনের প্রধান যেসব কারণ উল্লেখ করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- নরবলির বিকল্প, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বাড়ানো, প্রাচীন দ্রাবিড় ধর্মসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে লিঙ্গ উপাসনা, অতিথিদের আপ্যায়নের অঙ্গ হিসেবে পুরুষ অতিথির যৌনসুখ চরিতার্থ করা এবং ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মতো উঁচু জাতের লোকেদের দ্বারা নীচুজাতের শোষণ ইত্যাদি।

যৌনদাসী হিসেবে জীবন ‘উৎসর্গ’ করেছেন এসব নারী

এই অমানবিক প্রথা নির্মূলে ভারতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও তা সফল হচ্ছেনা। এইচআইভি এবং যৌনবাহিত সংক্রমণ সম্পর্কে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, কী ধরনের চিকিৎসা করাতে হবে সে বিষয়ে সচেতনতা জাগানোর পাশাপাশি দেবদাসীদের রুজিরোজগারের ব্যবস্থা করতে সম্প্রতি এগিয়ে এসেছে দেশটির কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

প্রথমে নারীদের এই যৌনশোষণের প্রথা নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৮৮ সালে। তবে তা কার্যকর করা যায়নি। পরে ২০১৫ সালে একটি সংগঠনের আবেদনের ভিত্তিতে দেবদাসী প্রথা তুলে দিতে কর্ণাটক রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। স্বেচ্ছাসেবী ওই সংগঠনটির অভিযোগ, বে-আইনি হলেও মন্দির বা বিগ্রহের কাজে নারীদের ‘উৎসর্গ’ করার প্রাচীন প্রথা এখনও চলছে।

ওই বছর কর্ণাটক রাজ্যের দেবনগর জেলার উত্তরঙ্গমালা দুর্গা মন্দিরে রাতের বেলায় নারীদের দেবতার নামে ‘উৎসর্গ' করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে- এই মর্মে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি অভিযোগ করলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন এক বেঞ্চ রাজ্যের মুখ্যসচিবকে ঐ অনুষ্ঠান বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ধারণা করা হয়েছিল, এর ফলে দেবদাসীদের সামাজিক যৌনশোষণ বন্ধ হবে। কিন্তু তা হয়নি। আসলে রক্ষণশীল ভারতের অনেক মানুষ এখনও ওই রায় মেনে দিতে প্রস্তুত নয়।

দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্রে, ওড়িষায় এবং গুজরাটে দেবতাকে উৎসর্গ করার নামে দেবদাসীদের প্রধানত দেহভোগের কাজে ব্যবহার করা হয় এখনও। দেবতা বা মন্দিরে উৎসর্গ করার পর তাদের পরিচয় হয় দেবদাসী। কোনও কোনও অঞ্চলে বলা হয় ‘যোগিনী’।

গো নিউজ২৪/ আরএস

এ সম্পর্কিত আরও সংবাদ


আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর