যে রাজ্যে মেয়েদের বুক ঢাকলে দিতে হতো ‘স্তনকর’


আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ১৮, ২০১৭, ১২:৫৯ পিএম
যে রাজ্যে মেয়েদের বুক ঢাকলে দিতে হতো ‘স্তনকর’

আধুনিক কালে বিভিন্ন ধরনের কর ব্যবস্থার কথা জানি আমরা। আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, আমদানি কর, রফতানি কর ইত্যাদি। কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন মেয়েদের স্তন ঢেকে রাখলেও কর দিতে হতো! শুধু কর দিলেই কোনও নারী কাপড় দিয়ে তার বুক ঢাকতে পারতেন। বেশিদিন আগে না, এই উনিশ শতকেও ভারতের কেরালা অঞ্চলে প্রচলিত ছিল এই প্রথা।

বর্তমান কেরালার একটি অংশ ছিল তখন ত্রাভানকোর রাজ্য। এই রাজ্যেই নিম্নবর্ণের হিন্দু নারীদের স্তনসহ বুক ঢাকতে হলে দিতে হতো ‘স্তনকর’। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হতো ‘মুলাককারাম’। মূলত নিম্নবর্ণের মানুষকে অসম্মানিত করতেই তখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। নিম্নবর্ণের মানুষের বেশিরভাগের আয়ও ছিল নিম্ন। তাই কথিত স্তনকর দেয়া সম্ভব হতো না তাদের পক্ষে। ফলে স্তনসহ বুক খোলা রাখতে হতো তাদের।

বর্ণবাদী সেই সমাজে মনে করা হতো, পোশাক পরার অধিকার থাকবে শুধু ‘উচ্চবর্ণের’ মানুষের। শুধু তাই নয়, ওই সময় রাজ্যের নারীপুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য অলঙ্কার পরা এবং পুরুষের জন্য গোঁফ রাখার জন্যও কর দিতে হতো। উচ্চবর্ণের পুরুষদের সামনে নারীদের বুক খোলা রাখতে হতো। এটাকে দেখা হতো ভদ্রতার নির্দশন হিসেবে। পোশাক ছিল তখন ধনসম্পদ ও আভিজাত্যের প্রতীক। তাছাড়া যেহেতু নিম্নবর্ণের মানুষ করের অর্থ পরিশোধ করতে পারতেন না, তাই তাদের অনেক বকেয়া পড়ে যেত। রাজার কাছে সব সময় ঋণ থাকতো। এভাবে আর্থিকভাবেও নিম্নবিত্তদের দমন করা হতো।

অনেকে মনে করেন, আধুনিক যুগে এসে ইউরোপের দেশগুলো যখন তাদের সমাজ, সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মুসলিম নারীদের বোরকা ও হিজাব নিষিদ্ধ করেন, তখন তাদের বর্ণবাদী মানসিকতাই ফুটে ওঠে। ২০০ বছর এসেও পোশাকের ক্ষেত্রে সেই বর্ণবাদী চিন্তা ত্যাগ করতে পারেনি ইউরোপ।

বুক খোলা নারীদের ছবি

যাই হোক, কেরালার স্তনকর নিয়ে স্যামুয়ের ম্যাটিয়ার লিখেছেন তার ‘নেটিভ লাইফ ইন ট্রাভানকোর’ বইতে। ওই বইয়ে তখনকার সময়ে প্রচলিত আরও ১১০ ধরনের করের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। সেই সময়ে কেরালায় প্রচলিত ছিল খ্রিস্টান শাসন। আর খ্রিস্টান এবং ব্রাহ্মণ নারীরাই শুধু নীল রঙের জ্যাকেটের মতো এক ধরনের ব্লাউজ দিয়ে নিজেদের স্তন ঢেকে রাখতে পারতেন।

নিপীড়নমূলক এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তখন বেশ কয়েকটি বিদ্রোহও হয়েছিল। সিরিজ এই বিদ্রোহগুলোকে বলা হয়, ‘চান্নার রিভোল্ট’। এসব বিদ্রোহে খ্রিস্টানদের গির্জা এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। নিম্নবর্ণের নারীরা প্রকাশ্যে ব্লাউজ পরতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাজের ব্রিটিশ গভর্নরকে হস্তক্ষেপ করতে হয় বিষয়টিতে। পরপর দুই দফা আদেশের মধ্য দিয়ে নারীদের দেহের ওপরের অংশ আবৃত করে রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।

নারীবৈষম্যের বিরুদ্ধে এই বিপ্লবের প্রতীক বিবেচনা করা হয় ‘নাঙ্গেলি’ নামের এক নারীকে। নিজের স্তন কেটে ফেলে স্তনকরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এই নারী। যদিও নাঙ্গেলির এই গল্পটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত না, তবে স্তনকরের বিরুদ্ধে যে বড় ধরনের বিদ্রোহ হয়েছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

কেরালার চেরথালা শহরের বাসিন্দা ছিলেন নাঙ্গেলি। তার সম্পর্কে প্রচলিত গল্প অনুসারে, ৩৫ বছর বয়েসেও এই নারী ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। কিন্তু তার পরিবার ছিল দরিদ্র। পরিবারের জন্য রোজগার করতে প্রতিদিনই বাইরে যেতে হতো তাকে। কিন্তু বুক খোলা রাখতে রাজি ছিলেন না নাঙ্গেলি। ফলে অনেক টাকা স্তনকর জমে যায় তার।

নাঙ্গেলিকে নিয়ে চিত্রকর্ম

এক পর্যায়ে তার বাড়ী গিয়ে করের টাকার আদায়ে তাগাদা দিতে থাকে রাজার লোকেরা। কিন্তু তার পক্ষে এই টাকা পরিশোধ করা সম্ভব ছিল না। একদিন তিনি কর সংগ্রহকারীদের অপেক্ষা করতে বলে মেঝেতে একটা কলাপাতা বিছিয়ে একটি প্রদীপ জ্বালেন। এরপর প্রার্থনা শেষ করে কেটে ফেলেন নিজের স্তন দুটো। কলাপাতায় মুড়িয়ে তা দিয়ে যান কর আদায়কারীদের হাতে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় নাঙ্গেলির। এই নারীর চিতায় ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন তার স্বামীও।    

নাঙ্গেলিকে নিজের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন ভারতের চিত্রশিল্পী টি মুরালি। অ্যাক্রেলিকে আঁকা সেই ছবি ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে ভারতীয় ব্রহ্মণ্যবাদীদের মধ্যে। সমালোচিতও হয়েছেন তিনি।

তবে মুরালি বলেন, ‘চেরথালার সবাই নাঙ্গেলির গল্প জানে। বছরের পর বছর ধরে লোকের মুখে মুখে প্রচলিত রয়েছে তার নির্ভীক আত্মদানের ইতিহাস।’ এখনও ভারতের অনেক জায়গায় নারীদের প্রবেশ করতে দেয়া হয় না মন্দিরে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন দরকার বলে মনে করেন দেশটির অনেক অধিকার কর্মী।

গো নিউজ২৪/ আরএস

এ সম্পর্কিত আরও সংবাদ


আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর