হ্যালো, এটা কি রহিম সাবের নম্বর?' হ্যাঁ-সূচক জবাব দিতেই টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর কণ্ঠ-'আমি শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ছোট ভাই, নাম শরীফ। ব্যাক্কে (সবাই) গালকাটা শরীফ ডাকে। যাউকগা-ভালোই তো বাণিজ্য করতাছেন? আমগো দিকে একটু খেয়াল-টেয়াল না রাখলে হইবো? সামনে ঈদ, পোলাপানরা ঈদ করব। আপনে দুই লাখ টাকা ঈদ বকশিশ দিবেন। হামনের (সামনের) সপ্তায় পোলাপান পাঠামু, টাকা রেডি রাইখেন। না দিলে কিন্তু ব্যবসা বন্ধ।'
মঙ্গলবার রাত সোয়া ৯টার দিকে এমনই একটি মোবাইল কল ঘুম কেড়ে নিয়েছে মিরপুরের ঠিকাদার আবদুর রহিমের।
শুধু আবদুর রহিম নন, ঈদ সামনে রেখে গত কয়েকদিন ধরে প্রায়ই এ ধরনের ফোন পাচ্ছেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। আবার চিরকুট পাঠিয়ে ঈদ বকশিশের নামে চাঁদার টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে কোনো কোনো এলাকায়। পাড়া-মহল্লায় ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের নাম ভাঙানো ছাড়াও প্রয়োজনে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা তোলা অব্যাহত আছে।
ফুটপাত থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীদের ঈদ বকশিশের নামে সালাম (চাঁদার জন্য) পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে পরিবহন খাতেও চাঁদার পরিমাণ বেড়েছে। এ ব্যাপারে গত ১৫ দিনে রাজধানীর থানাগুলোতে শতাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে।
ব্যবসায়ী, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এসব সাধারণ ডায়েরি করেছেন। রাজধানীর ফুটপাত থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলার ঘটনা এখন স্বাভাবিক মনে হলেও ঈদ সামনে রেখে এর পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে।
কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঁদাবাজির এ ভয়াবহ চিত্র। ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজিতে বেসামাল রাজধানীর ব্যবসা-বাণিজ্য। চাঁদা দিতে না চাইলে সন্ত্রাসীরা বুকে পিস্তল ধরে এমনও বলছে, 'হয় চাঁদা না হয় জীবন' কোনটি দিবি? চাঁদা দে নইলে জীবন যাবে।' এ রকম হুমকির মুখে অনেকে বাধ্য হয়ে যেভাবে হোক চাঁদার টাকা জোগাড় করছেন।
এ অবস্থায় একেবারে সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী কেউই রেহাই পাচ্ছেন না চাঁদাবাজির রাহুগ্রাস থেকে। জীবনের ওপর হুমকি আসবে বলে ভয়ে কেউ পুলিশের কাছে মুখ খুলতে চান না। অগত্যা ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের আতঙ্কেই দিন কাটছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে চঁাদাবাজি নিয়ে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য বেরিয়ে আসে।
জানা গেছে, সড়ক থেকে মহাসড়ক-ফুটপাত, মার্কেট থেকে বাসাবাড়ি, কাঁচাবাজার, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, বাস টার্মিনাল সর্বত্রই এখন চাঁদাবাজরা বেপরোয়া। রমজান শুরুর আগেই শত কোটি টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে রাজধানীর ফুটপাত।
পলিটিক্যাল ক্যাডারদের সঙ্গে এখানে ভাগ বসিয়েছে ফুটপাত দেখভালের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও সিটি কর্পোরেশনের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা। রাজধানীতে অঞ্চল ভেদে তিন-চার হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্তের ফুটপাত এককালীন বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকায়। এরপরও এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঈদ বকশিশের নামে প্রতিদিন বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। ব্যবসার এ ভরা মৌসুমে ঘাটে-ঘাটে চাঁদা গুনতে গিয়ে 'শিকেয়' ওঠার উপক্রম হয়েছে তাদের মুনাফা।
অন্যদিকে ঈদ বাণিজ্যের নামে ট্রাফিক-পুলিশের দৌরাত্ম্যও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কারণে-অকারণে রাস্তার মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মামলা দেয়ার নামে চলছে এক প্রকার প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজির টার্গেট নিয়েই মাঠে নামে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও পলিটিক্যাল ক্যাডররা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নাম করেও ফায়দা লুটছে সন্ত্রাসীরা।
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের কাছে চিরকুট পাঠিয়ে ঈদ-সালাম পৌঁছে দিচ্ছে তারা। চিরকুটে সন্ত্রাসীরা চাঁদা দেয়ার নির্দষ্টি তারিখ উল্লেখ করে দিচ্ছে। নগদ টাকার পাশাপাশি চাঁদা হিসেবে জামা-কাপড়ও দাবি করছে তারা। এসব ব্যবসায়ীর অনেকেই নিরাপত্তার কথা ভেবে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বিষয়টি আপসরফা করে নিয়েছেন।
কিন্তু চাঁদাবাজির এসব অভিযোগ মানতে নারাজ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। শুক্রবার তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে চাঁদাবাজি এখনও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেনি।
তিনি বলেন, চাঁদাবাজির কিছু কিছু অভিযোগ আসছে। তবে চাঁদাবাজি ঠেকাতে নানা রকমের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক রয়েছে।
এদিকে বড় অঙ্কের চাঁদাবাজির শিকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী মুখ খুললেও পরিচয় প্রকাশ করে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। বরং বার বার অনুরোধ করেন যেন কোনোভাবে তাদের এই ক্ষোভ যন্ত্রণার বিষয় কোথাও প্রকাশ করা না হয়। কারণ, তারা আশঙ্কা করেন যারা তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়েছেন তারা জানতে পারলে একেবারে জীবনে মেরে ফেলতে পারে। পরিবারের ওপর নানাভাবে বিপদ নেমে আসার শঙ্কা আছে।
এদের মধ্যে বংশাল এলাকার একজন রডের পাইকারী ব্যবসায়ী প্রতিবেদককে বলেন, তাকে এক গ্রুপকে দিতে হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। কমপক্ষে আরও একটি গ্রুপকে দিতে হবে দুই-তিন লাখ টাকা। এর বাইরে পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজারের পার্টি আছে বেশ কয়েকজন। তাহলে বলেন, কিভাবে ব্যবসা করব?
বাড্ডা এলাকার অপর একজন ব্যবসায়ী জানান, 'দুটো পিচ্চি পোলা আমার কাছে আইসা চাইছিল দুই লাখ টাকা। আমি কইলাম ব্যবসা ভালা না। এত টাকা দিমু কইথন? এরপর যন্ত্র বাইর কইরা কইল, চাঁদা দিবি নইলে জীবন।'
তিনি জানান, পরে কমবেশি কইরা টাকা জোগাড় করে পরিস্থিতি সামাল দিছি।'
গো নিউজ২৪