ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের কারণে এখন যা হচ্ছে


নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ৩১, ২০২৩, ০৯:৫৭ এএম
ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের কারণে এখন যা হচ্ছে

চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) কোনো মাসেই বেসরকারি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি ব্যাংক খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলার সংকট, মুদ্রা পাচার এবং আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়া সার্বিকভাবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ফলে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। তারও আগে ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ।

আর্থিক সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। এসবের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশেও। বিশেষ করে ডলার সংকট বেশ ভোগাচ্ছে বাংলাদেশকে। এ সংকট সমাধানে সরকার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে। এতে রিজার্ভের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এপ্রিল শেষে দেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমে ৩০ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও এখন সে অঙ্ক আরও কমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়ন ডলারে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণের চাহিদা ওঠানামা করে। হঠাৎ বাড়ে। আবার কমে। বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিতে কড়াকড়ি করার পর কিছুটা কমেছে। আবার এখন বাড়তি। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের কারণে। যদিও জুন থেকে সুদের হার বাড়বে। এজন্য অনেকেই নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াচ্ছেন। গত কয়েক মাসে ডলারের দাম ২০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ফলে আমদানিকারকদের ঋণপত্রের মূল্য বেড়ে গেছে। এর কারণে ঋণের পরিমাণ বাড়ার কথা থাকলেও তা কমেছে। এতে বেসরকারি খাতে প্রভাব তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

সাধারণভাবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে থাকে। তবে ২০১৯ সালের নভেম্বরে প্রথমবারের মতো তা নেমে যায় ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর পর ব্যাপক হারে কমে ২০২০ সালের মে-র শেষে প্রবৃদ্ধি নামে ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে। তবে পরে জুন থেকে তা অল্প অল্প করে বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে আরও দেখা যায়, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ ব্যাংকের করা প্রাক্কলনের চেয়েও কম। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর ২০২১-২২-এ প্রাক্কলন করেছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। যদিও প্রাক্কলিত হারের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রার অর্জন ছিল অনেক কম।

এদিকে অর্থের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়েছে সরকার। অর্থবছরের শুরু থেকেই এই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, তারল্য সংকটের কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকে তেমন একটা ঋণ দিতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ২৪ মে পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার ২৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগের অর্থবছরে সরকার নিয়েছিল ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকারদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাজারে টাকা ছাড়ার ফলে নোটের পরিমাণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১ টাকা বাজারে ছাড়লে তা ৫ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। মার্চে ভোক্তা মূল্যসূচক ৭ মাসের সর্বোচ্চ বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ হওয়ায় এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে আসে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যা ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত বছরের মে মাসে রিজার্ভ ছিল ৪২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। তা ২৮ শতাংশ কমে গত মাসে ৩০ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ডলারের দর বৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানি, বাজারে পণ্য সংকট, মূল্যস্ফীতি ও টাকার সরবরাহ সবই একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।

আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিতে চায় ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। ৬ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের প্রাথমিক আকার ধরা হচ্ছে প্রায় ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ লাখ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি বাজেট দাঁড়াবে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। সরকার এ ঘাটতি অর্থায়নের জোগান দেবে তিন জায়গা থেকে। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আসবে ১ লাখ কোটি টাকা, ব্যাংক খাত থেকে নেবে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে। অর্থ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বেশি ঋণ নেবে সরকার।

এসব বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া মানে বাজারে টাকা ছাড়া, যা মুদ্রাস্ফীতি ও লেনদেন ভারসাম্যের (বিওপি) ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। অর্থায়ন কমে যায় বেসরকারি খাতে। ফলে কমে যেতে পারে নতুন কর্মসংস্থান। জনগণের হাতে অতিরিক্ত অর্থ থাকলে পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে, যা দাম বৃদ্ধি করবে। বিপুল পরিমাণ অর্থ বাজারে ছাড়লে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এই কর্মকর্তা। অর্থের প্রচলন বেড়ে গেলে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বেড়ে যায়, যার ফলে আমদানিও বাড়ে।

অর্থনীতি বিভাগের আরো খবর