অনলাইনে তিন পাত্তি গোল্ড খেলে ৯ কোটি টাকা পাচার


নিউজ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ৪, ২০২৩, ০৯:০৩ এএম
অনলাইনে তিন পাত্তি গোল্ড খেলে ৯ কোটি টাকা পাচার

আয়কর পরিশোধ না করে সেই টাকা লভ্যাংশ হিসাবে সিঙ্গাপুরে পাচার করেছে উল্কা গেমস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। পাচার হওয়া টাকার অঙ্ক ৯ কোটি ৩৯ লাখ। প্রতিষ্ঠানটি তিন পাত্তি গোল্ড নামে একটি অ্যাপস বানিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ এবং পরে তা বিভিন্ন কায়দায় বিদেশে পাচার করত। এ কাজে সহযোগিতা করেছে স্থানীয় অডিট ফার্ম ও আয়কর উপদেষ্টা হিসাবে কর্মরত একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিন পাত্তি গোল্ড একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ। এর মাধ্যমে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই ভার্চুয়ালি জুয়া খেলা চলত। প্রতিদিন ভার্চুয়াল বোর্ডে লেনদেন হতো কোটি কোটি চিপস (জুয়ার কয়েন)। এসব চিপস বিক্রিতে কাজ করত দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা কয়েকশ ডিলার। এরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেজ খুলে চিপস বিক্রি করত। এক কোটি চিপস বিক্রি হতো ৭৫ টাকা, ২ কোটি চিপস ১৫০ টাকা, ৩ কোটি চিপস ২২৫ টাকা, ৪ কোটি চিপস ৩০০ টাকা, ৫ কোটি চিপস ৩৭৫ টাকা, ১০ কোটি চিপস ৭১০ টাকা, ১৪ কোটি চিপস ১ হাজার টাকা, ২০ কোটি চিপস এক হাজার ৪২০ টাকায়।

বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনের তথ্যমতে, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধক (আরজেএসসি), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমতি নিয়ে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে উল্কা গেমস লিমিটেড। এর স্থানীয় মূলধন ছিল মাত্র এক লাখ টাকা এবং বিদেশি মূলধন এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি মুনফ্রগ এশিয়া পিটিই লিমিটেডের শেয়ার ছিল ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ (৯৯ হাজার ৬৯০টি), এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক তনয় বিরিজ মোহন তায়াল ভারতের নাগরিক। আর মাত্র ১টি শেয়ারের মালিক ছিলেন বাংলাদেশে নাগরিক জামিলুর রশিদ। শুরুতে অনকিত জৈন ও পুষ্পেষ কুমার নামে আরও দুজন ভারতীয় নাগরিক মালিকানায় যুক্ত থাকলেও ২০২০ সালের মার্চে তারা পদত্যাগ করেন।

গত বছরের ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির স্থানীয় অংশীদার জামিলুর রশিদসহ ৬ জনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী র‌্যাব। র‌্যাব জানায়, নিয়মিত ৯ লাখ জুয়াড়ি অ্যাপের মাধ্যমে জুয়া খেলতেন। তাদের কাছে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি করা হতো। এভাবে হাতিয়ে নেওয়া প্রায় ২০০ কোটি টাকা ভারতে পাচার করা হয়। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও ২০১৯ সালে কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে উল্কা গেমস লিমিটেড।

মূলধন হিসাবে সিঙ্গাপুরের মুনফ্রগ এশিয়া পিটিই লিমিটেড থেকে এক কোটি টাকা এবং ভারতের কোম্পানি মুনফ্রগ ল্যাবস প্রাইভেট থেকে সফটওয়্যার কনসালট্যান্সি বাবদ ৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা বাংলাদেশ পাঠানো হয়। বাংলাদেশের ৪টি ব্যাংকে ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সালের ২ নভেম্বর পর্যন্ত ৪০৬ কোটি টাকা জমা হয় এবং উত্তোলন করা হয় ৩১২ কোটি টাকা। উত্তোলনকৃত টাকা থেকে ২০২১ সালে ২৯ কোটি টাকা লভ্যাংশ হিসাবে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে। পরে অর্থ পাচারের সন্দেহে ৯৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা জব্দ করেছে বিএফআইইউ। এখনো ব্যাংক হিসাবগুলো জব্দকৃত অবস্থায় আছে।

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, উল্কা গেমস লিমিটেডের ৩টি ব্যাংকে পরিচালিত চলতি হিসাবে একক স্বাক্ষরকারী এবং অন্য একটি ব্যাংকে যৌথ স্বাক্ষরকারী ছিলেন মোহন তায়াল, তার স্বাক্ষরে হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলিত হয়েছে। অথচ ইমিগ্রেশন পুলিশের রেকর্ড অনুযায়ী তায়াল কখনো বাংলাদেশে আসেননি। কিন্তু ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক সাধারণ সভার রেজুলেশন এবং অডিট রিপোর্টে তার স্বাক্ষর পাওয়া গেছে। অর্থাৎ তিনি সশরীরে উপস্থিত না হয়ে ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করেছেন এবং তার আবেদনেই সিঙ্গাপুরে লভ্যাংশের অর্থ পাঠানো হয়েছে। এক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে ব্যাংক লেনদেনে ভিসাসহ পাসপোর্টের কপি রাখার নিয়ম থাকলেও ব্যাংকগুলো সে নির্দেশনা পরিপালন করেনি। অবশ্য বাংলাদেশি পার্টনার জামিলুর রশিদ ২০১১-২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪ বার এবং ২০১৮-২০২২ সাল পর্যন্ত ১৩ বার ভারতে ভ্রমণ করেছেন।

অর্থ পাচার অনুসন্ধান করতে গিয়ে কর ফাঁকির প্রমাণ পায় বিএফআইইউ। প্রতিষ্ঠানটি আয়কর পরিশোধ না করে সেই টাকা লভ্যাংশ হিসাবে সিঙ্গাপুরে পাচার করেছে। এ কাজে সহযোগিতা করেছে স্থানীয় অডিট ফার্ম হাওলাদার মারিয়া অ্যান্ড কোং এবং স্থানীয় আয়কর উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান এইস অ্যাডভাইজরি। ২০২০ এবং ২০২১ সালের অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা করে বিএফআইইউ দেখতে পায়, এ সময় প্রতিষ্ঠানটির মোট আয় ছিল যথাক্রমে ৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং ২৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা। কিন্তু নিরীক্ষা প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটিকে গেম ডেভেলপার হিসাবে দেখিয়ে কর অব্যাহতি সুবিধা দাবি করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী রিটার্ন জমা দেওয়া হয়। অথচ আয়কর অধ্যাদেশে গেম ডেভেলপমেন্ট কোম্পানিকে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়নি। এ কায়দায় প্রতিষ্ঠান ৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকা কর ফাঁকি দিয়ে সেই টাকা বিদেশে পাচার করেছে।

বিএফআইইউ’র তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উল্কা গেমসের আয়কর রিটার্ন পর্যালোচনাপূর্বক প্রতিষ্ঠানটির কর ফাঁকি দেওয়ার মাধ্যমে মানি লন্ডারিং অপরাধ সংগঠন এবং সিঙ্গাপুরে অর্থ পাচারের বিষয়ে তদন্ত পরিচালনা করা দরকার।

একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির নিযুক্ত অডিট ফার্ম হাওলাদার মারিয়া অ্যান্ড কোং এবং আয়কর উপদেষ্টা এইস এডভাইসরি মানি লন্ডারিং ও কর ফাঁকিতে সহায়তা করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এছাড়া মূল উদ্যোক্তা তনয় বিরিজ মোহন তায়াল বাংলাদেশের বাইরে অবস্থান করেও কীভাবে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন ও স্থানান্তর করেছে এবং বিদেশে লভ্যাংশ পাঠিয়েছে সে বিষয়টিও পর্যালোচনা প্রয়োজন।

অপরাধ চিত্র বিভাগের আরো খবর