ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ যে লেখাটির জন্য ঢাবি শিক্ষককে অব্যাহতি!


গো নিউজ২৪ প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০১৮, ০৭:৪০ পিএম
‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ যে লেখাটির জন্য ঢাবি শিক্ষককে অব্যাহতি!

যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন কিছু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের জন্ম হয় যারা দেশ-কাল পেরিয়ে বিশ্বদরবারে নিজ অবস্থান স্থায়ী করে নিয়েছেন স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে, স্বীয় কর্মগুণে। আজ আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের আলোকে তেমনি একজন মানুষ সম্পর্ক দু-চারটি কথা লিখতে যাচ্ছি। তিনি আর কেউ নন- আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জনক রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি মা জাহানারা খাতুন রানীর কোলজুড়ে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব হয়। তার ডাকনাম রাখা হয় কমল। তার পিতার নাম মনছুর রহমান। তিনি পেশায় ছিলেন রসায়নবিদ। তিনি ছিলেন অবিভক্ত ভারত সরকারের কর্মকর্তা এবং কর্মসূত্রে কলকাতায় বসবাস করতেন। তাই তো জিয়াউর রহমানের লেখাপড়ার হাতেখড়ি কলকাতার বিখ্যাত 'হেয়ার স্কুল'-এ। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এই বয়েজ স্কুলে লেখাপড়া করেন। হেয়ার স্কুলে পড়ার সময় জিয়াউর রহমানের শিশুমনে ব্যাপক রেখাপাত করেন দুজন রাজনৈতিক নেতা- নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু ও মহাত্মা গান্ধী। 
 
 ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর জিয়াউর রহমানের পরিবার পশ্চিম পাকিস্ত্মানে চলে যায়। পিতার কর্মসূত্রে করাচিতে নতুন জীবন শুরু করেন তারা। করাচির ডি জে কলেজে শিক্ষাজীবন শুরু করেন জিয়াউর রহমান। এই কলেজে পড়াকালেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেন। করাচি কাবুল মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণকালে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান ব্যাপক অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও চাকরি লাভের অধিকারের বৈষম্য তার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। 

সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানি ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার মানসে তিনি বাঙালি যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতেন সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বাঙালি সেনা ও অফিসারদের রোল মডেলে পরিণত হন। মেজর পদে উন্নীত হওয়ার পর তাকে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়, প্রথম জয়দেবপুরে পরে চট্টগ্রামে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে যখন পাক-হানাদার বাহিনী এ দেশের নিরীহ, নিরপরাদ ও ঘুমন্ত মানুষের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের লীলা-খেলায় মেতে ওঠে তখন তৎকালীন রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধের লেশমাত্র পাওয়া যায়নি। আর মানুষ এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে বিনা প্রতিবাদে ও বিনা বাধায় ঝরে গেল মূল্যবান জীবন ও বিনষ্ট হলো অনেক সম্পদ। এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে আওয়ামী নেতারা বেশির ভাগই তাদের পরিবার-পরিজনসহ ভারতে চলে গেলেন, এদেশবাসীকে মৃত্যুর ফাঁদে ফেলে দিয়ে। 

অন্যদিকে জাতির এই সংকটকালীন সময় ত্রাতারূপে আবির্ভাব ঘটে মেজর জিয়াউর রহমানের। দেশপ্রেমের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত হন তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখেন, যা বাঙালি জাতি আজীবন স্মরণে রাখবে।
দীর্ঘ ২৬৬ দিনের লড়াই-সংগ্রামে ৩০ লাখ তাজা প্রাণের রক্ত ও তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে মেজর জিয়া নায়কোচিত ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও স্বাধীনতার পরপরই তিনি তার কর্মস্থলে ফিরে যান। সদ্য স্বাধীন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের কাঁধে। সমগ্র দেশবাসী শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরেই তাদের স্বপ্নের জাল বোনে, আশার প্রদীপ জ্বালে, সোনার বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে আবদ্ধ হয়। কিন্তু শেখ মুজিব সবাইকে হতাশ করলেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অভিযাত্রিক অগ্রভাগে থেকেই গণতন্ত্রকে হত্যা করলেন। দেশব্যাপী চালু করলেন একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা। হত্যা, লুণ্ঠন, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ধর্ষণসহ বহুবিধ অপরাধমূলক কর্মকা- ব্যাপক আকারে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়ে সমগ্র সমাজজীবন পর্যুদস্ত হয়ে সর্বত্র বিরাজমান হয় সামাজিক নৈরাজ্য। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪-এ দেশ এক ভয়ানক দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে নিপতিত হয়। দুর্ভিক্ষ এতটাই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল যে কবি রফিক আজাদ লিখতে বাধ্য হন, 'ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খামু'। ১৯৭২-৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত দেশে বাকস্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না। সরকারের অনুগত চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। সরকারের কোনো কাজের সমালোচনা কিংবা কোনো জনকল্যাণ বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করলেই শুরু হতো অমানুষিক নির্যাতন-নিপীড়ন। এমনকি গুম-হত্যাও শুরু হয় ব্যাপক আকারে। সরকারের এই দমন-পীড়ন, নির্যাতন ও বাকস্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে বিশিষ্ট ছড়াকার আবু সালেহ লেখেন, 'ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা; রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা'। এমনই এক নৈরাজ্যময় পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতীয় জীবনে সংঘটিত হয় আর এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে সামরিক বাহিনীর একাংশের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। জাতি আবার ঘোর অন্ধকারের অমানিশায় পথ হারায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাসদ যদি ৭ নভেম্বর (১৯৭৫) সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসতে পারত তবে তা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের জন্য মহাবিপদ হিসেবে দেখা দিত। কারণ জাসদের সংগঠন বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় পর্যন্ত্ম ছিল। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দল হলো জাসদ। যার কারণে ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জাসদের অনেক নেতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতার পাদপ্রদীপে আসায় আওয়ামী লীগ ধ্বংসযজ্ঞের সেই যাত্রা থেকে পরিত্রাণ পায়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সেই জাসদই আজ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার পরম বন্ধু।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশকে গণতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই রাজনৈতিক দলবিধি জারি করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথকে উন্মুক্ত করে দেন। শেখ মুজিব বাকশাল গঠনের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করেছিলেন। 

এর মধ্যে আওয়ামী লীগও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগের প্রতি কত সহনশীল ছিলেন তার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে তিনি তা দেখিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল জাতীয় সংসদে শেখ মুজিবের নামে একটি শোক প্রস্ত্মাব গ্রহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রস্তাব করছে যে, 'বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে বাংলাদেশ রাজনীতি জগতে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বকে হারিয়েছে। এই সংসদ তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছে।' পরে জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। অথচ সেই সংসদে দাঁড়িয়েই আজ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ও তার চেলাচামুন্ডারা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করছে, তার স্বচ্ছ ইমেজকে কালিমাযুক্ত করার প্রতিনিয়ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। যা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। তবে আওয়ামী শিষ্টাচার বলে গ্রহণযোগ্য। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের অনুপস্থিতির কারণে ১৫ আগস্টের মতো বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সত্যিকারার্থে ফলপ্রসূ হয় জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রনায়কোচিত ও দার্শনিক চিন্তাচেতনার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। জিয়াউর রহমান যে জনগণের কতটা কাছাকাছি গিয়েছিলেন, জনগণ তাকে কতটা কাছে টেনে নিয়েছিল তার বাস্ত্মব চিত্র ফুটে ওঠে লরেন্স জায়রিংয়ের লেখায়। 'A People&_s President') সাব হেডিং-এ লরেন্স জায়রিং (Lawrence Ziring, Bangladesh : from Mujib :o Ershad : An Interpretive Study) গ্রন্থের 146 পৃষ্ঠায় লিখেছেন, "Zia ingratiated himself with :he peasant masses. They received his primary attention and whenever his schedule permitted, he helicopter around :he country, dropping out of :he sï often unannounced :o viwe peasant conditions, first hand and :o discuss :he methods and :he resources available :o raise :hem from :heir poverty. অর্থাৎ জিয়া জনগণের মধ্যে তাদের একজন হিসেবে মিশে গেলেন। তারাই জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং যখনই তিনি সময় পেতেন তখনই হেলিকপ্টারে চড়ে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে দেখতেন। কোনো ঘোষণা ছাড়াই অকস্মাৎ আকাশ থেকে তিনি নেমে আসতেন নিজের চোখে দরিদ্র কৃষকদের অবস্থা দেখতে এবং দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্ত করার উপায় এবং উৎস সম্পর্কে আলোচনা করতেন।" তাইতো জন্মের ৮২ বছর পরেও তিনি আমাদের মধ্যে বেঁচে আছেন স্বমহিমায়, জ্যোতির্ময়তায়।

লেখক:
ড. মোর্শেদ হাসান খান : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ ও সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এদিকে লেখাটি প্রকাশের পর মোর্শেদ হাসানের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ করে আসছিল ছাত্রলীগ। মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্তের দাবিতে ২৮ মার্চ উপাচার্যকে স্মারকলিপিও দেয় ছাত্রলীগ।

এর প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক সব ধরনের কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় সোমবার (২ এপ্রিল)। 

গেল মার্চের শেষের দিকে জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্তের অনলাইন ভার্সনে ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামে মোর্শেদের হাসানের লেখাটি প্রকাশিত হয়।

মোর্শেদ হাসান খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন।

এর আগে গত ২৮ মার্চ প্রকাশিত ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ প্রবন্ধের জন্য আন্তরিক ক্ষমা ও দুঃখ প্রকাশ করেন অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান।

 

গো নিউজ২৪/আই

সংবাদপত্রের পাতা থেকে বিভাগের আরো খবর
ব্যাংকে জমানো আমানত কমে যাচ্ছে

ব্যাংকে জমানো আমানত কমে যাচ্ছে

কারা হবে বিরোধী দল, লাঙ্গল না স্বতন্ত্র?

কারা হবে বিরোধী দল, লাঙ্গল না স্বতন্ত্র?

বিভিন্ন ছাড়ে ব্যাংক খাতের আসল চিত্র আড়ালের সুযোগ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বিভিন্ন ছাড়ে ব্যাংক খাতের আসল চিত্র আড়ালের সুযোগ দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

পাসপোর্ট এনআইডিসহ ১৯ কাজের অতি প্রয়োজনীয় জন্মসনদ এখন ‘সোনার হরিণ’

পাসপোর্ট এনআইডিসহ ১৯ কাজের অতি প্রয়োজনীয় জন্মসনদ এখন ‘সোনার হরিণ’

সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় যে ব্যাংক

সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় যে ব্যাংক

প্রশাসনের শীর্ষ পদে পদোন্নতিপ্রত্যাশীদের হতাশা বাড়ছে

প্রশাসনের শীর্ষ পদে পদোন্নতিপ্রত্যাশীদের হতাশা বাড়ছে