ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাবার লাশ দেখার শর্ত ছিল, কাঁদা যাবে না: কঙ্কা


গো নিউজ২৪ | নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: আগস্ট ১৫, ২০১৮, ১০:৪৮ এএম
বাবার লাশ দেখার শর্ত ছিল, কাঁদা যাবে না: কঙ্কা

ঢাকা: বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন আমার বাবা। বাবাকে হত্যা করার পর তার লাশটিও ঘাতকরা আমাদের দেখতে দিতে চায়নি। এক পর্যায়ে বিশেষ শর্ত বেঁধে দেয়া হয়, লাশ দেখে কাঁদা যাবে না। আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে রেখেছিল ঘাতক সেনা সদস্যরা। তাক করা রাইফেলের সামনেও আমার বড় বোন, আম্মা আর আমি কাঁদছিলাম।

আমার বড় বোন যখন আর্তনাদ শুরু করলেন তখন সেনারা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মাথায় রাইফেল তাক করে সেনা সদস্যরা করে, ‘স্টপ, কাঁদলেই শ্যুট করে দেব’। আপু তখনও কাঁদছিলেন। পরে কেউ একজন আপুকে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে শাহাদাতবরণ করেছেন, বাবার এ বীরত্ব আমাদের কাছে সবচেয়ে গর্বের।  শোক ও ভীতিকর সেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে শহীদ কর্নেল জামিল আহমেদের দ্বিতীয় মেয়ে আফরোজা জামিল কঙ্কা বারবার কেঁদে উঠছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল ঘাতক সেনাদের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে শাহাদাতবরণ করেন কর্নেল জামিল।

কঙ্কা জানান, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে বাবা-মায়ের উচ্চস্বরের কথাবার্তায় আমার এবং বড় বোন তাহমিনা এনায়েত তুন’র ঘুম ভেঙে যায়। গণভবনেই আমাদের বাসা ছিল। মা-বাবার শয়নকক্ষের পাশেই ছিল আমাদের থাকার রুমটি।

আরো পড়ুন: যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই

ঘুম থেকে উঠে দেখি মা-বাবা বিচলিত, অস্থির হয়ে উঠছেন। পরে জেনেছি, বঙ্গবন্ধু ফোন করেছেন, তিনি বিপদে আছেন। লাল ফোনটা বেজে উঠতেই মা ফোনটা ধরলেন, ওপাশ থেকে বঙ্গবন্ধু বলছিলেন, ‘এই জামিল কই? জামিলকে তাড়াতাড়ি দে।’ মা দ্রুত ফোনটি বাবাকে দিলেন, বাবা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে ফোনটি রেখেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। বললেন, বঙ্গবন্ধুর বাসায় হামলা হয়েছে।

ওই সময় বাবা দ্রুত সেনাপ্রধানসহ একাধিক পদস্থ কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান। ওই সময়ের সেনাপ্রধান কেএম সফিউল্লাহ ফোর্স পাঠাবেন বলে বাবাকে আশ্বস্ত করেছিলেন। এরপর দ্রুত তৈরি হয়ে সিভিল পোশাকেই বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে ছুটে চলেন। মায়ের প্রতি বাবার শেষ কথা ছিল, তুমি আমার মেয়েদের খেয়াল রেখ। আমি বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে যাচ্ছি। কথাগুলো বলতে বলতে দু’চোখ জলে ভরে উঠছিল কঙ্কার।

যেভাবে নিহত হন কর্নেল জামিল:  কর্নেল জামিলের গাড়িচালক আইনউদ্দিন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ২০ নম্বর সাক্ষী। তাঁর চোখের সামনেই নিহত হন কর্নেল জামিল। আইনউদ্দিনের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ভোর ৫টার দিকে তাঁর রুমের কলিং বেল বেজে ওঠে। তখন তিনি অজু করছিলেন। তাড়াতাড়ি বাসার সামনে গেলে কর্নেল জামিল ওপর থেকে দ্রুত গাড়ি তৈরি করতে এবং গণভবনে গিয়ে সব ফোর্সকে হাতিয়ার-গুলিসহ পাঁচ মিনিটের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ জানাতে বলেন। গণভবনে সৈনিকদের নির্দেশ জানিয়ে তিনি ফিরে এলে কর্নেল জামিল তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে রওনা হন। ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোডের মাথায় তাঁরা গণভবন থেকে আসা ফোর্সদের দেখেন। সোবহানবাগ মসজিদের কাছে পৌঁছলে দক্ষিণ দিক থেকে শোঁ শোঁ করে গুলি আসতে থাকে। তখন ফোর্স অ্যাটাক করানোর কথা বললে কর্নেল জামিল বলেন, এটা ওয়ার-ফিল্ড নয়, ফোর্স অ্যাটাক করালে সিভিলিয়ানদের ক্ষতি হতে পারে।

তখন আইনউদ্দিনকে প্রতিপক্ষের অবস্থান জেনে আসতে নির্দেশ দিয়ে কর্নেল জামিল গাড়িতেই বসে থাকেন। আইনউদ্দিন যখন দেয়াল ঘেঁষে ৩২ নম্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন পাঁচ-ছয়জন সেনা সদস্য দৌড়ে জামিলের গাড়ির দিকে যায়। তিনি (আইনউদ্দিন) হাতে ইশারা করে কর্নেল জামিলকে সরে যেতে বলেন। স্যার, স্যার বলে আওয়াজও করেন কয়েকবার। কিন্তু কর্নেল জামিল তাঁর দিকে তাকাননি।

কর্নেল জামিলকে হত্যার মুহূর্তের কথা জানিয়ে আইনউদ্দিন বলেন, ওই সময় আর্মির অস্ত্রধারী লোকগুলো গাড়ির কাছে পৌঁছে যায়। কর্নেল জামিল দুই হাত উঠিয়ে তাদের কিছু বলার বা বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা দুই-তিনটি গুলি করলে কর্নেল জামিল মাটিতে পড়ে যান।

জোটেনি কাফনের কাপড়, জানাজা:  সেদিন পথভ্রষ্ট সেনা সদস্যরা শুধু বর্বর হত্যাকাণ্ড চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। তারা নিহত ব্যক্তিদের লাশের প্রতিও নির্মমতা দেখিয়েছে। পদস্থ সেনা কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও সেদিন কর্নেল জামিলের জানাজা পড়ানো হয়নি, কাফনের কাপড়ের ব্যবস্থাও করা হয়নি। সেনা পাহারায় কোনো রকম গোসল করিয়ে, বিছানার চাদর দিয়ে মুড়িয়ে বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাঁকে।

এ প্রসঙ্গে আফরোজা জামিল বলেন, আমার চাচি আমেরিকা থেকে বিছানার একটা সাদা চাদর এনেছিলেন। তা দিয়েই বাবাকে সমাহিত করা হয়। বাবাকে ভালোমতো গোসলও করানো হয়নি। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের স্ত্রী আজমির শরিফ থেকে আতর আর কিছু সুগন্ধি এনে বাসায় রেখেছিলেন। উনি সেগুলো দেন বাবাকে দাফনের আগে। দাফনের সময়ও রক্তে চাদর ভিজে যাচ্ছিল।

৭৫-এর সেই নির্মম অধ্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শী কঙ্কার বয়স তখন ১২ বছর। তার চেয়ে তিন বছরের বড় ছিলেন তনু। কঙ্কার ছোট্ট যে বোনটি তার নাম ফাহমিদা আহমেদ শ্বেতা। ১৫ আগস্টের মাসখানেক পর কর্নেল জামিলের স্ত্রী আনজুমান আরা বুঝতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। স্বামীর মৃত্যুর আট মাস পর জন্ম নেয় তাদের কনিষ্ঠ কন্যা কারিশমা জামিল।  কঙ্কা জানালেন, বাবার শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে বহু স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

গো নিউজ২৪/এমআর

 

 

 

এক্সক্লুসিভ বিভাগের আরো খবর
যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিয়ে করতে চান, তাদের যে বিষয়গুলো জেনে রাখা দরকার

যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিয়ে করতে চান, তাদের যে বিষয়গুলো জেনে রাখা দরকার

নিরাপদ বিনিয়োগের অপর নাম সঞ্চয়পত্র, কোনটি কিনতে কী কাগজপত্র লাগে

নিরাপদ বিনিয়োগের অপর নাম সঞ্চয়পত্র, কোনটি কিনতে কী কাগজপত্র লাগে

ঢাকা শহরে সব কাজই করেন মেয়র, এমপির কাজটা কী

ঢাকা শহরে সব কাজই করেন মেয়র, এমপির কাজটা কী

নতুন আয়কর আইনে একগুচ্ছ পরিবর্তন

নতুন আয়কর আইনে একগুচ্ছ পরিবর্তন

দলিলের নকলসহ মূল দলিল পেতে আর ভোগান্তি থাকবে না

দলিলের নকলসহ মূল দলিল পেতে আর ভোগান্তি থাকবে না

ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানতকারীদের আয়কর রিটার্ন নিয়ে যা জানা জরুরী

ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানতকারীদের আয়কর রিটার্ন নিয়ে যা জানা জরুরী