ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘রক্ষণশীল মুসলিম থেকে যেভাবে লেসবিয়ান হলাম’


গো নিউজ২৪ | নিউজ ডেস্ক: প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০১৮, ০৯:২৫ পিএম
‘রক্ষণশীল মুসলিম থেকে যেভাবে লেসবিয়ান হলাম’

৭০-এর দশকে আমি যখন একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠছিলাম, তখন সমকামিতা নিয়ে কথা বলা তো দূরে থাক, এমনকি টেলিভিশন পর্যন্ত ঠিকমতো দেখতে পারতাম না।

‘তুমি কি মেয়েদেরকে পছন্দ করো? ১৯৯১ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে আমার বয়ফ্রেন্ড যখন প্রথমবার আমাকে এ প্রশ্নটি করল, আমি তখন হতবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ থেকে সদ্য ভারতে প্রত্যাবর্তন করা রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের একটি মেয়েকে এ প্রশ্ন শুনতে হবে—এটা আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

মেয়েদেরকে পছন্দ করো মানে কী?’ আমি জবাব দিলাম।

‘না, আমি বলছি তুমি কি মেয়েদের প্রতি আসক্ত?’ আমার বয়ফ্রেন্ড পাল্টা প্রশ্ন করল।

‘এটা কীভাবে সম্ভব? আমি নিজে একজন মেয়ে হয়ে কীভাবে আরেকজন মেয়ের প্রতি আসক্ত হতে পারি? এটা কি সম্ভব? তুমি কী বলতে চাইছো?’ আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম।

আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় আমার সেই বয়ফ্রেন্ড তখন আমাকে সমকামিতা কী, সেটা ব্যাখ্যা করল। সে বলল, এমন অনেক পুরুষ আছে, যারা অন্য পুরুষদের প্রতি রোমান্স অনুভব করে। অনেক নারীও আছে এমন।

আমি এমন নারীদের মতো কি না—সে আবারও প্রশ্ন করল।

শেষ কবে এতটা লজ্জা পেয়েছি ও এতটা ক্ষুব্ধ হয়েছি, তখন মনে করতে পারছিলাম না।

আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম, আমি এমন নারীদের মতো নই। সে কী বলছিল, তার কোনো অর্থই আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম ও কেন আমাকে এসব জিজ্ঞেস করল?

৭০-এর দশকে আমি যখন একটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে বেড়ে উঠছিলাম, তখন সমকামিতা নিয়ে কথা বলা তো দূরে থাক, এমনকি টেলিভিশন পর্যন্ত ঠিকমতো দেখতে পারতাম না। তখন আমাদের কাছে সমকামিতা দূর মহাকাশের অপরিচিত এক শব্দ। কেউ এ শব্দ উচ্চারণ করত না, এমনকি ঠাট্টাচ্ছলেও কেউ এটা নিয়ে কথা বলত না। মনে হতো এ নামে পৃথিবীতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

স্কুল-কলেজে পড়া শেষ করার পরও এ নিয়ে কখনো কাউকে কথা বলতে শুনিনি। ভারতে আসার পর আমার বয়ফ্রেন্ডের কাছেই সর্বপ্রথম এ শব্দটি শুনলাম।

আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তার কেন মনে হচ্ছে আমি মেয়েদের প্রতি আসক্ত, তখন সে আমাকে বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করল। সব ঘটনাই আমার মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আমার আচরণ নিয়ে। ও বোঝাতে চাইল প্রতিটি ঘটনাতেই আমি বেশ আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম, যেটা ছেলেদের ক্ষেত্রে কখনো হইনি। সে বলল, ‘আমি হয়তো ভুল হতে পারি। কিন্তু আমার মনে হয়েছে তুমি তোমার মেয়ে বন্ধুদের প্রতি মানসিকভাবে বেশি সম্পৃক্ত এবং তাদের বেশি খেয়াল রাখো।’

আমি তার এসব দাবি খারিজ করে দিলাম। কিন্তু মনে মনে আমি সেই ঘটনাগুলো আবার মনে করলাম। আমার মনে হলো ও সত্যি কথাই বলছে। ওসব ঘটনায় আমি মেয়ে বন্ধুদের প্রতি যতটা আবেগ দেখিয়েছি, ছেলেদের প্রতি এত আবেগ কখনো দেখাইনি। কিন্তু এর আগে আমি ভাবতাম এটা শুধু বন্ধুদের প্রতি একটা অনুভূতি। এর বাইরে অন্য কোনো চিন্তা আমার মাথায় আসেনি।

আমার হিন্দু, অর্থোডক্স খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন বিশ্বাসের অনেক মেয়ে বন্ধু ছিল। কিন্তু কথার ছলেও কেউ আমার সঙ্গে সমকামিতা নিয়ে কখনো আলাপ করেনি। আমিও একসময় এটা ভুলে গেলাম এবং স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাতে শুরু করলাম। 

আমি বিয়ে করলাম, বিয়ে ভেঙে গেল, আবারও বিয়ে করলাম। কিন্তু কখনো মনে হলো না আমি কিছু জিনিস মিস করছি।

আমি কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি করেছি, সন্তানকে বড় করেছি, সমকামিতা নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো, তারপরও এসব নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ হয়নি। এমনকি সমকামীদের কেস স্টাডি পড়ার সময়ও আমার কখনো নিজেকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মনে হয়নি। পত্রিকায় প্রায়ই সমকামীদের পক্ষে-বিপক্ষে আইন, সমকামীদের অধিকার আদায়ের নানা আন্দোলনের ছবি দেখতাম।

পাঁচ-ছয় বছর আগে হঠাৎ করে নিজেকে একদিন এমন এক পরিস্থিতে আবিষ্কার করলাম, যেটি আমাকে দ্বিধা ও অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। কাজের খাতিরে আমাকে এক নারীর সঙ্গে দেখা করতে হয়েছিল। কথা বলার একপর্যায়ে তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে থাকলাম। আগে কখনো কারো প্রতি আমার এমন অনুভূতি হয়নি। মনে হলো, বহুদিন পর আমার মধ্যে এত তীব্র অনুভূতি কাজ করেছে।

আমার মনে অনেক কিছু খেলছিল। ওই নারী আমাকে কেন এত আকর্ষণ করল? অপরাধবোধের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করলেও এবার নিজের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করলাম, ফের যদি আমার মধ্যে এমন অনুভূতি আসে, তাহলে আর সেটি উপেক্ষা করব না।

হ্যাঁ, আমার মধ্যে আবারও একই অনুভূতি হলো এবং একপর্যায়ে এটি নিয়মিতই হতে শুরু করল। আমি বুঝতে পারলাম এটা সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভূতি এবং কোনো পুরুষের জন্য কখনো আমার এ অনুভূতি কাজ করেনি।

কিছুদিন দ্বিধাগ্রস্ত থাকার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করব। জানার চেষ্টা করব আমিই কী এ ধরনের একমাত্র ব্যক্তি, নাকি আমার মতো আরও কেউ আছে। আমি মনে মনে ভাবলাম, যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার কারণে আমার মধ্যে এমন পরিবর্তন এলো কি না। শিশু ও তরুণ বয়সে আমি পুরুষের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি, কিন্তু কখনো কারো সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করিনি। আমি ভাবলাম পুরুষের প্রতি ঘৃণা থেকেই কি নারীদের প্রতি আমার আকর্ষণবোধ কাজ করছে?

দুই বছর এভাবে দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় কাটানোর পর একদিন গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম বহু মানুষের অভিজ্ঞতা আমার সঙ্গে একদম হুবহু মিলে গেছে। আমার বয়স তখন ৪৫ বছর এবং প্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়ে আছে আমার। গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম আমার মতো বয়সের, আমি যে রক্ষণশীল সমাজ থেকে এসেছি এবং আমার আরও আনুষঙ্গিক বিষয়াদির সঙ্গে মিল আছে, এমন নারীরাও তাদের যৌন ইচ্ছার পরিবর্তনের কথা লিখেছে। অনেকের অভিজ্ঞতা আমার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে গেছে।

সেদিন গুগলে সার্চ দেওয়ার জন্য আমি এখনো নিজেকে ধন্যবাদ দেই। আমি সেদিন বুঝতে পেরেছি আমি একা নই, আরও অনেকেই আছে আমার মতো। তারা অনেকে বয়স্ক, বিবাহিত, অনেকে তরুণী, অনেকের আবার সন্তানও আছে। এমনকি আমি এমন অনেক নারীর অভিজ্ঞতাও পড়েছি, যারা ৬০ ও ৭০-এর দশকে জন্ম নিয়েছিল। তারা আমার প্রজন্মেরই মানুষ। আমি বুঝতে পারলাম আমি স্বাভাবিক আছি, আমি ঠিক আছি।

এবার আমার মনে হলো বিবাহিত জীবনে আমি কী মিস করছিলাম!

আমার এ পরিবর্তনের ব্যাপারে প্রথম যে কয়জন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বললাম, তাদের একজন ছিল আমার মেয়ে। নিজের সমকামিতার ব্যাপারে কথা বললে মানুষের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সেটি নিয়ে সন্দিহান ছিলাম আমি। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সে এক বছর আগে থেকেই ব্যাপারটি লক্ষ্য করছিল। সে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আমার বুক থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে গেল।

আমার কিছু বন্ধু আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল আমি যাতে সবাইকে এটা বলে দেই। কিন্তু আমি সেটা করলাম না। কারণ তখনো নিজের এ সত্যটা স্বীকার করে নেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তার ওপর এটা বললে মানুষ বিরক্ত হতো, দ্বিধায় পড়ে যেত কিংবা ব্যাপারটা তারা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারত না। এরপর নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করা শুরু হলো আমার। যেসব নারীর সঙ্গে আমার দেখা হবে, তারা কি ভাববে আমি তাদের প্রতি আকৃষ্ট? তারা কী আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইবে? আমার সন্তানের বন্ধুবান্ধবরা তাকে নিয়ে উপহাস করবে? আমার পরিবর্তনটা কেউ মেনে নেবে কি না—এসব ভাবতে লাগলাম। কিন্তু কোনো উত্তর পেলাম না।

এরপর ভাবলাম আমার সঙ্গী কে হবে? সঙ্গী কোথায় খুঁজব! আমার এক বন্ধু একটি ডেটিং অ্যাপের খোঁজ দিল। প্রথম কয়েক সপ্তাহ ওই ডেটিং অ্যাপটি ব্যবহার করতে আমার একটু অদ্ভুত লাগছিল, কারণ সেখানে সবাই একদমই তরুণ।

এরপর কয়েক বছর কেটে গেল। আমি আমার নতুন জীবনে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিলাম এবং সমাজের নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলাম। সবাইকে নিজের জীবন ও ভালোবাসা সম্পর্কে বোঝানো খুবই দীর্ঘ ও কষ্টকর প্রক্রিয়া। কিন্তু এখন একটা জিনিস নিশ্চিত—এখন সমাজের কথা শোনার আগে আমি আমার মনের কথা শুনি।

(এ লেখাটি হাফিংটন পোস্টে প্রকাশিত হয়েছে। যে নারী এটি লিখেছেন, তিনি তার নাম বা পরিচয় গোপন রেখেছেন। )

 

গো নিউজ২৪/আই

এক্সক্লুসিভ বিভাগের আরো খবর
যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিয়ে করতে চান, তাদের যে বিষয়গুলো জেনে রাখা দরকার

যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিয়ে করতে চান, তাদের যে বিষয়গুলো জেনে রাখা দরকার

নিরাপদ বিনিয়োগের অপর নাম সঞ্চয়পত্র, কোনটি কিনতে কী কাগজপত্র লাগে

নিরাপদ বিনিয়োগের অপর নাম সঞ্চয়পত্র, কোনটি কিনতে কী কাগজপত্র লাগে

ঢাকা শহরে সব কাজই করেন মেয়র, এমপির কাজটা কী

ঢাকা শহরে সব কাজই করেন মেয়র, এমপির কাজটা কী

নতুন আয়কর আইনে একগুচ্ছ পরিবর্তন

নতুন আয়কর আইনে একগুচ্ছ পরিবর্তন

দলিলের নকলসহ মূল দলিল পেতে আর ভোগান্তি থাকবে না

দলিলের নকলসহ মূল দলিল পেতে আর ভোগান্তি থাকবে না

ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানতকারীদের আয়কর রিটার্ন নিয়ে যা জানা জরুরী

ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানতকারীদের আয়কর রিটার্ন নিয়ে যা জানা জরুরী