আজ ভয়াল ২৫ মে। ২০০৯ সালের ২৫ মে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্নিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা ‘আইলা’ আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে। সর্বগ্রাসী আইলার ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের উপকুল জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত আইলা কবলিত হাজার হাজার পরিবার এখনও পুনর্বাসিত হয়নি। আশ্রয়হীন জনপদে এখনও চলছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও খাবার পানির তীব্র হাহাকার। সর্বগ্রাসী আইলা আজও উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত হাজার, হাজার মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ মে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্নিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা আইলার আঘাতে মুহুর্তের মধ্যে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি ও খুলনা জেলার কয়রা ও দাকোপ উপজেলার উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪-১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নারী ও শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ, হাজার হাজার গবাদী পশু আর ঘরবাড়ি। ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে লাখো পরিবার। লক্ষ লক্ষ হেক্টর চিংড়ি আর ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকুল রক্ষা বাঁধ আর অসংখ্য ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সর্বনাশা আইলার আঘাতে শুধু সাতক্ষীরায় নিহত হয় ৭৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশু আর আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ।
প্রলয়ঙ্করী আইলা আঘাত আনার ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও উপকুলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশশুনির প্রতাপনগর এলাকায় মানুষের হাহাকার এতটুকু থামেনি। দু‘মুঠো ভাতের জন্য জীবনের সাথে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। আইলার পর থেকে এসব এলাকায় সুপেয় পানি সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। খাবার পানির জন্য ছুটতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। আইলা কবলিত এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট, উপকূলীয় বেড়িবাধ এখনও ঠিকমত সংস্কার হয়নি। ফলে উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্মবিত্ত সবাই চালাচ্ছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
ক্ষতিগ্রস্ত আইলা কবলিত এ বিশাল জনপদে স্বল্প সংখ্যক সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আইলার ভয়াবহতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নে বসবাসরত মানুষের চোখে মুখে এখনও ভয়ংকর সেই স্মৃতি। আইলার আঘাতের পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভিদ শুন্য হয়ে পড়ে। কৃষি ফসল ও চিংড়ী উৎপাদন বন্ধ থাকায় গোটা এলাকাজুড়ে তীব্র কর্মসংস্থানের সংকট দেখা দিয়েছে। কর্মহীন মানুষ অনেকেই এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছে। অপরদিকে, বনদস্যুদের অত্যাচারে সুন্দরবন, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর উপর নির্ভরশীল এ এলাকার মানুষের জীবন যাপন দূর্বিসহ হয়ে পড়েছে। ফলে বিকল্প কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা না থাকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছেন না উপকুলীয় এ জনপদের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। আইলার পরপরই কিছু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কাজের বিনিময় খাদ্য প্রকল্পের কাজ হলেও এখন আর কোনো কাজ হচ্ছে না। আর এ কারণেই ক্রমে ক্রমে বাড়ছে দরিদ্র ও হত দরিদ্রের সংখ্যা।
এদিকে, আইলার ৯ বছর অতিবাহিত হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকুল রক্ষা বেড়িবাঁধগুলোর ভয়াবহ ফাঁটল দেখা দেয়ায় এবং সংস্কার না করায় সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতে ঝূঁকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে এ জনপদের কয়েক লাখ মানুষকে। তাই উপকুলীয় এ জনপদের মানুষের সরকারের কাছে দাবী টেকসই উপকুল রক্ষা বেড়িবাধ নির্মাণ ও বেকার জনগোষ্ঠির কর্মস্থানের ব্যবস্থা করা।
স্থানীয় বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা নওয়াবেকী গনমুখী ফাউন্ডেশনের পরিচালক মো.লুৎফর রহমান বলেন, আমরা বেসরকারি উদ্যোগে মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছি। লবন পানিকে মিষ্টি পানিতে রুপান্তরিত করে খাবার উপযোগী করছি। পুকুর খনন করেছি।
তিনি আরো জানান, আইলার আঘাতের পর মানুষের জীবন ধারণের সব সুযোগ হারিয়ে গেছে। চিকিৎসা নেই। প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট সংখ্যক সাইক্লোন শেল্টারও নেই।
শ্যামনগর উপজেলা (ভারপ্রাপ্ত) নির্বাহী অফিসার সুজন কুমার সরকার জানান, আইলার পরে প্রায় ৪৮ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ঘর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সাথে তিনি ক্ষতিগ্রস্তপরিবার প্রতি ২০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদানও দিয়েছেন। তিনি আরো জানান, সরকারী-বেসরকারীভাবে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। বাঁধ সংস্কারের কাজও করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, সুপেয় পানির সমস্যাও দ্রুত দুর হয়ে যাবে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো-২) নির্বাহী প্রকৌশলী অপূর্ব কুমার ভৌমিক বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলায় সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-০১ ও ০২ এর আওতাধীন ১১ টি পোল্ডারে ৮'শ কিলোমিটার বেঁড়িবাধেই কমবেশী ক্ষতি হয়। তাৎক্ষনিকভাবে সে সময় ক্লোজ আপ দিয়ে পানি বন্ধ করা হয়। আইলা উপকূলীয় এ এলাকায় স্থায়ী ভাবে বেড়িবাধ নির্মাণের জন্য ইতিমধ্যে সিআইপি (এডিপির একটি প্রকল্প) তারা জরিপ কাজ করেছেন। স্থায়ী বেড়িবাধ নির্মাণের জন্য তিনি দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
গো নিউজ২৪/আই