ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

৪৬ বছর ধরে চলছে ‘শহীদ’ স্বীকৃতির যুদ্ধ


গো নিউজ২৪ | উপজেলা প্রতিনিধি প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০১৭, ০৯:৪৩ এএম
৪৬ বছর ধরে চলছে ‘শহীদ’ স্বীকৃতির যুদ্ধ

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ):স্বাধীনতার পর কেটে গেছে ৪৬ বছর। সুদীর্ঘ এই সময়ে সরকারের পালা বদল হয়েছে অনেকবার। কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ২৫টি পরিবার এখনো ‘শহীদ’ পরিবারের স্বীকৃতি পায়নি।

এরমধ্যে শুধু শালীহর গ্রামেই পাক বাহিনীর গণহত্যায় শহীদ হয়েছেন ১৪ জন। পাকবাহিনীর ভয়ে সেদিন শালীহর গ্রামের হিন্দু পরিবারের সদস্যরা প্রথাগতভাবে শহীদদের মৃতদেহ সৎকার করতে পারেনি। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে মৃতদেহগুলো মাটি চাপা দিয়েছিল। এসব স্মৃতি চিহ্নগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আশুতোষ রায় এবং আবুল হাসিমের উদ্যোগে প্রতিবছর শালীহর গ্রামে শহীদদের স্মরণ সভার আয়োজন করা হত। ২০১০ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. ক্যাপ্টেন (অব) মজিবুর রহমানের উদ্যোগে শহীদের স্মৃতি রক্ষায় শালীহর গ্রামের বদ্ধভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও সেখানে শহীদের কোনো নামের তালিকা নেই। স্বজন হারানোর ব্যাথা নিয়ে এসব শহীদ পরিবারের অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। আর যারা বেঁচে আছেন তারা চালিয়ে যাচ্ছেন স্বীকৃতির যুদ্ধ। তবে কাঙ্ক্ষিত সেই স্বীকৃতি কবে মিলবে, আদৌ মিলবে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারো।

শহীদ পরিবার ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল পাকবাহিনী রামগোপালপুর হয়ে গৌরীপুর শহরে ঢুকে। সেদিন পাকবাহিনী শহরের পৃথক পৃথক স্থানে গুলি করে হত্যা করে বিমল সরকার, রেবতী সরকার ও সতিষা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ব্রজেন্দ্র বিশ্বাসকে।  ১৯৭১ সালের ১৬ মে শালীহর গ্রাম থেকে মধুসূদন ধর ও কৃষ্ণ লাল সাহাকে ধরে নিয়ে যায় পাক বাহিনী। এরপর দুজনকেই নান্দাইলের মুসুলির রেলওয়ে কাঁটাতারের ব্রিজের নিচে চোখ বেঁধে হত্যা করে পাকবাহিনী। 

শহীদ মধুসূদন ধরের ছেলে সাংবাদিক সুপ্রিয় ধর বাচ্চু বলেন, ‘আমার বড় বোন সুপ্রিয়া ধর অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক, ছোট ভাই ড. সুব্রত শঙ্কর ধর বিশ্ব ব্যাংকে কর্মরত, ছোট বোন সুপীতি ধর বিবিসি বাংলা বিভাগের সিনিয়র রিপোর্টার। স্বাধীনতার পর আমরা কোনো সুবিধা চাইনি, শুধু চেয়েছি বাবার আত্মদান ‘শহীদ’ মর্যাদার স্বীকৃতি। কিন্তু সুদীর্ঘ ৪৬ বছরে সেটা পূরণ হয়নি। স্বীকৃতি প্রাপ্তির বিষয়টি মায়ের খুব চাওয়া ছিল কিন্তু সেটা তিনি ৩৮ বছরেও পাননি। ২০১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পারিবারিক ভাবে আমাদের এই স্বীকৃতিটুকু কিন্তু প্রাপ্য ছিল।’

১৯৭১ সালের ২১ আগস্ট পাক বাহিনী একটি বিশেষ ট্রেনে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে বিসকা রেলওয়ে স্টেশনে নেমে পড়ে। এরপর তৎকালীন বিসকার রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার সলিম উদ্দিন (অবাঙালি) এবং আল বদর কমান্ডার আব্দুল মান্নান ফকিরের নেতৃত্বে উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত শালীহর গ্রামে হানা দিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও তাণ্ডব চালায় পাকবাহিনী। গুলি করে হত্যা করে ১ জন মুসলমানসহ  ১৩ জন হিন্দুকে। গুলির মুখ থেকে কলেমা পাঠ করে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান নগেন্দ্র চৌকিদার। তবে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায় গ্রামের বাসিন্দা ছাবেদ আলী বেপারীকে। এরপর দীর্ঘ ৪৬ বছরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।  

সেদিন গ্রামে ঢুকেই পাকবাহিনী প্রথমেই গুলি করে হত্যা করে নিরীহ কৃষক নবর আলীকে। এরপর একে একে হত্যা করে মোহিনী মোহন কর, জ্ঞানেন্দ্র মোহন কর, যোগেশ চন্দ্র বিশ্বাস, কিরদা সুন্দরী, শচীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, তারিনীকান্ত বিশ্বাস, দেবেন্দ্র চন্দ্র নম দাস, খৈলাস চন্দ্র নম দাস, শত্রুগ্ন নম দাস, রামেন্দ্র চন্দ্র সরকার, অবনী মোহন সরকার, কামিনী কান্ত বিশ্বাস, রায় চরণ বিশ্বাসকে।  

এছাড়াও ২৫ আগস্ট তাতকুড়া গ্রামের মৃণাল কান্তি বিশ্বাস ও ২৭ নভেম্বর মলামারা গ্রামের অধর সরকারকে গুলি করে হত্যা করে পাকবাহিনী। একই দিনে ময়মনসিংহ শহরের ব্যবসায়ী অধর সরকারের গৌরীপুরের বাসায় আশ্রিত শ্যাম বল্লদ সাহা, রমেশ চন্দ্র পাল, যোতিন্দ্র চন্দ্র পালকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত তাদের কোনো খোঁজ পায়নি পরিবার। তবে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি সান্ত্বনাপত্র ও অনুদানের দুই হাজার টাকা পেয়েছিল পাল পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু স্বীকৃতি পায়নি।

শহীদ জ্ঞানেদ্র করের ছেলে সীতাংসু কর বলেন, ‘৭১ সালের ২১ আগস্ট পাক বাহিনী আমার বাবা ও জেঠা মোহিনী মোহন করকে গুলি করে হত্যা করে। বাবাকে যেখানে হত্যা করা হয়েছিল তার পাশেই শালীহর বদ্ধভূমির স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও সেখানে বাবা কিংবা গ্রামের অন্যান্য শহীদদের কোনো নামফলক নেই। পাইনি আমরা শহীদ পরিবাবের মর্যাদাটুকুও। সংস্কারের অভাবে বদ্ধভূমিটি গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। যেন দেখারও কেউ নেই।’

শহীদ পরিবারের সদস্য গীরিবালা বলেন, ‘পাকসেনাদের আসার খবর পেয়ে শালীহর গ্রামের উত্তর পাড়ার এক মুসলিম বাড়িতে আমি ও আমার স্বামীর বড় বোন প্রেমাদা আশ্রয় নেই। এ সময় আশ্রয়দাতা আমাদের খর-বন ও চাটাই দিয়ে ঢেকে রাখে। দীর্ঘপথ দৌঁড়ানোর কারণে চাটাইয়ের নিচে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমাদের উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে পাকবাহিনী আমাদের ঘেরাও করে আটকে রাখে। এসময় আমার শ্বশুর কামিনী কান্ত বিশ্বাস, কাকা শ্বশুর তারিনীকান্ত বিশ্বাস, কাকি শাশুড়ি কিরদা সুন্দরীকে চোখের সামনে গুলি হত্যা করে। স্বাধীনতার পর বহুবার সাংবাদিকরা আমাদের গ্রামের ঘটনা ও পরিবারের দুঃখের কাহিনী সংগ্রহ করে পত্রিকায় লেখা-লেখি করলেও এখন পর্যন্ত আমরা কোনো স্বীকৃতি কিংবা সরকারি সহযোগিতা পাইনি। কিন্তু কেন পাইনি? আমাদের অপরাধ কোথায়?’

ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ বলেন, ‘বিভিন্ন জটিলতার কারণে ৭১ সালে শালীহর গ্রামসহ গৌরীপুরে শহীদ হওয়া অনেক পরিবার শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি পায়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে দাবি যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে শহীদ পরিবারগুলোর চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করে যেন তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কারণ স্বীকৃতিটা তো তাদের প্রাপ্য।

ইউএনও মর্জিনা আক্তার জানান, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে শালীহর গ্রামে শহীদদের চূড়ান্ত তালিকা করে বদ্ধভূমিতে নামফলক লাগানো হবে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে গৌরীপুরের অন্যান্য শহীদ পরিবারগুলোর বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে তালিকা তৈরি করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ময়মনসিংহ-৩ গৌরীপুর আসনের সংসদ সদস্য নাজিম উদ্দিন আহমেদ জানান, শালীহর স্মৃতিস্তম্ভের সংস্কার, সৌন্দর্য বর্ধন ও সেদিনের গণহত্যায় শহীদ ১৪ জনের নাম পরিচয়ের ফলকও রাখা হবে স্মৃতিস্তম্ভে।  এছাড়া যাচাই-বাছাই করে অন্যান্য শহীদ পরিবারগুলোর তালিকাও করা হবে। 

গোনিউজ/এমবি

দেশজুড়ে বিভাগের আরো খবর
মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কোটি টাকা নিয়ে পালালো ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট

মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কোটি টাকা নিয়ে পালালো ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট

দিনের শুরুতেই বিআরটিসি বাসের চাপায় নিহত ৪ 

দিনের শুরুতেই বিআরটিসি বাসের চাপায় নিহত ৪ 

ধারের টাকা দিতে না পারায় বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ে

ধারের টাকা দিতে না পারায় বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ে

বোমাটি বিস্ফোরিত হলে বাসের সবাই মারা যেতেন

বোমাটি বিস্ফোরিত হলে বাসের সবাই মারা যেতেন

রেললাইনে বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা, হাতেনাতে আটক ৩

রেললাইনে বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা, হাতেনাতে আটক ৩

হাতকড়া পরা অবস্থায় বাবার জানাজায় বিএনপি নেতা

হাতকড়া পরা অবস্থায় বাবার জানাজায় বিএনপি নেতা