ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সেকালে যেভাবে ঢাকায় ঈদ আয়োজন হত


গো নিউজ২৪ | অনলাইন ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ২৭, ২০১৭, ০৮:২৪ পিএম
সেকালে যেভাবে ঢাকায় ঈদ আয়োজন হত

সুফি সাধক ও আরবীয় বণিকদের দ্বারা ঢাকায় ঈদ উৎসবের যে প্রচলন শুরু হয়েছিল, মোগল আমলে এসে সেই উৎসব জমকালো রূপ ধারণ করে। রাজধানীর মর্যাদা হারালেও নায়েবে-নাজিমদের আমলে ঢাকায় ঈদের চাঁদ দেখা, ঈদ জামাত, ঈদ মিছিল ও ঈদ মেলার জৌলুস বজায় ছিল। সে ধারাবাহিকতায় রং মিশিয়েছেন নবাবরা। প্রযুক্তির উৎকর্ষে আজ সেই উৎসবে যুক্ত হয়েছে নিত্যনতুন মাত্রা। ঢাকাবাসীর ঈদ বিনোদনের ঐতিহাসিক নানা দিক তুলে ধরেছেন হোসাইন মোহাম্মদ জাকি

ঢাকার উনিশ শতকের সাহিত্য ও সংবাদ-সাময়িকপত্রে ঈদবিষয়ক তথ্যের উপস্থিতি ছিল যৎসামান্য। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিশিষ্টজনদের লেখা আত্মজীবনীতে কিঞ্চিৎ তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকায় সেলাইযুক্ত পোশাকের আগমন ঘটে মোগলদের হাত ধরে এক বিশেষ কারিগর শ্রেণির মাধ্যমে। যাঁরা পরিচিত ছিলেন দর্জি বা খলিফা নামে। ঢাকার দর্জিদের মিহি সেলাই, বিশেষত পাঞ্জাবির সেলাই ছিল ঈর্ষণীয়। 

নিজস্ব ডিজাইন ও প্যাটার্ন মতো কাপড় কেটে পুরোটাই সেলাই করতেন নিজ হাতে। সম্ভবত খলিফাদের এই নিজস্বতার ভেতরেই গড়ে উঠেছিল ঈদ ফ্যাশনের রেওয়াজ। ঈদের নতুন পোশাকবিষয়ক ভাবনাটা মূলত ঢাকার বিত্তশালীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। 

নবাবদের কোট, শেরওয়ানি, আচকান বানাতেন জিন্দাবাহারের কিংবদন্তিতুল্য দর্জি হাফিজ মিঞা। এত দক্ষ ছিলেন যে কারো শরীরের মাপ নিয়ে নয়, চেহারা একবার দেখে সে অনুসারে কাপড় কেটে শেরওয়ানি সেলাই করতেন। এ ছাড়া সে সময়ে বিখ্যাত ছিলেন আমলিগোলা মহল্লার রহমান খলিফা, ইসলামপুরের মতি খলিফা। তাঁদের উত্তরসূরি বশিরউদ্দিন। নিউ মার্কেটের বশিরউদ্দিন টেইলার্স এখনো মরহুম বশিরউদ্দিনের ঐতিহ্য বহন করে চলছে।

ধুতি অতঃপর লুঙ্গি
শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার সাত দশক’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের আগ পর্যন্ত মুসলিম পুরুষরা ধুতি পরেই ঈদের নামাজ পড়তে যেতেন। তখন নামাজে দাঁড়িয়ে ধুতির কোচা খুলে ফেলতেন তাঁরা। পরে ধুতির বদলে লুঙ্গির প্রচলন শুরু হয়। পাশাপাশি পায়জামা-পাঞ্জাবিও পরতে শুরু করে ঢাকাবাসীরা। বিশেষ করে ঈদের সময় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। পুরুষরা পরতেন সাদা ফুটফুটে গিলে করা আদ্দি কাপড়ের পাঞ্জাবি। ’ ফ্যাশন ডিজাইনার এমদাদ হক তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘একবার লাল পাঞ্জাবি কিনে ঈদের সকালে কী লজ্জাটাই না পেয়েছিলাম, যদিও এখন এটাই ফ্যাশন। ’

চানরাতে চুড়িওয়ালী
চল্লিশের দশকে ঢাকায় ঈদের আমেজ শুরু হয়ে যেত রোজার প্রথম থেকেই। পাটুয়াটুলী ছিল শহরের ধনী ক্রেতাদের জন্য নির্ধারিত। ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়, অমৃতলাল বস্ত্রালয়, ইস্ট বেঙ্গল স্টোর এবং বিসমিল্লাহ স্টোরের মতো বেশ কয়েকটি তৈরি পোশাকের বড় দোকান ছিল এখানে। এগুলোয় খুব বেশি ভিড় হতো না। ভিড় যা হতো মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের চকবাজার, সদরঘাট ও ইসলামপুর এলাকায়।

 নাট্যকার সাঈদ আহমদের তথ্য মতে, ইসলামপুর থেকে কাপড় কিনে তাঁদের বাড়িতে তৈরি করা হতো মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, দোপাট্টা ইত্যাদি। বাড়ির মেয়েরা যা সেলাই করত নিজস্ব সেলাই মেশিনে। বাজার থেকে শাড়ি কিনে এনে শাড়ির ওপর এমব্রয়ডারি, পুঁতির কাজ, বর্ডার (পাইপিং) দিয়ে শাড়িকে আকর্ষণীয় করা হতো। তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ঈদে ঢাকাবাসী নারীদের ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল ‘চানরাতে’ চুড়িওয়ালীদের কাছ থেকে চুড়ি কেনা এবং তাদের হাতে চুড়ি পরা। বাঁশের টুকরি মাথায় করে বাড়ি বাড়ি যেতেন চুড়িওয়ালীরা। 

বাড়ির ছোট থেকে বড় সবাই চুড়িওয়ালীদের হাতে চুড়ি পড়ত। চুড়িহাট্টা পল্লী জোগান দিত এই চুড়ির। রমণীদের পছন্দ ছিল সোনার বালার সঙ্গে মিলিয়ে রঙিন কাচের চুড়ি পরা। চুড়ির এই পাইকারি দোকানগুলো আজও টিকে আছে। ২৭ রমজান থেকে অন্দরমহলে মেহেদি রাঙানো শুরু হয়ে যেত। বিশেষ করে ‘চানরাতে’ মেহেদি উৎসব চলত পুরো শহরে। মেহেদিপাতা বেটে তখন হাত রাঙানো হতো। ‘আমরা ঢাকাবাসী’ সংগঠন নিয়মিত মেহেদি উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে মেহেদির নকশার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে ঢাকাবাসীর জীবনাচরণে।  

কাগজের টুপি ও আতরমাখা তুলা
সেকালে ঈদের নামাজের জন্য হাতে রং করা কাগজের টুপি তৈরি করা হতো। অসচ্ছল ও শ্রমিক শ্রেণিই সাধারণত এই টুপি কিনত। গোলাকৃতি এ টুপির দাম ছিল চারআনা থেকে আটআনা। কয়েকবার ব্যবহারে নষ্ট হয়ে গেলেও এর বেশ কদর ছিল। ফ্যাশনের আরেকটি আবশ্যিক পর্ব ছিল ঈদের আগের দিন চুল কাটা। সে সময় স্টাইল ছিল দিলীপ কাট। চুল কাটার আরেকটি স্টাইল ছিল দশআনা-ছয়আনা। অর্থাৎ সামনে বড় আর চারপাশে ছোট। পর্দাপ্রথার কারণে সাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজে পায়ের পাতার মাপ এঁকে দিত বাড়ির মেয়েরা। 

তাই দেখে বাড়ির পুরুষরা স্যান্ডেল কিনে আনত। লায়ন সিনেমা হলের বিপরীতে ছিল ‘ফিং ফোং’ নামে একটা চীনা মুচির জুতার কারখানা। এ দোকান থেকেই সরবরাহ করা হতো বিত্তশালী নারীদের স্যান্ডেল আর পুরুষদের জুতা। আদি ঢাকাবাসীর ঈদের আরেকটি ঐতিহ্য ছিল আতরমাখা।   যে কারণে প্রতিবছর ঈদের আগে জমজমাট হয়ে উঠত আতরপট্টি। দরবারিখাস, মিশকাম্বর, মেশক-জাফরান, গোলাপখাস—হরেক রকম নাম ছিল এসব আতরের। আতরমাখা তুলা কানের ভাঁজে গুঁজে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া ছিল ঢাকাবাসীর স্বকীয়তা।  

ঢাকার প্রাচীনতম ঈদগাহ
মোগল আমলে ঈদ উৎসব শুরু হতো শাওয়ালের চাঁদ দেখার পর। মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বি’তে তার প্রমাণ মেলে। উনিশ শতকের শেষদিক থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত নবাববাড়ি থেকে দেওয়া তোপধ্বনিতে চাঁদ ওঠার খবর পেত ঢাকাবাসী। শুরু হতো ‘চানরাত’। ঢাকাবাসীর রেওয়াজ ছিল দল বেঁধে ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া। ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন ঈদগাহ ছিল ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রোডে, যেটি নির্মিত হয়েছিল ১৬৪০ সালে। পুরনো ভগ্নাবশেষকে পুনর্নির্মাণ করে বর্তমানে এখানে নিয়মিত ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়।  

হাতে বানানো সেমাই
ঈদ উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতেই বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। চানরাতে মহল্লার বাড়িতে বাড়িতে সেমাই রান্নার ধুম পড়ে যেত। হাতে ঘোরানো কলে তা তৈরি হতো। বাড়িতে সেমাইয়ের কল ব্যবহার করাটা ছিল আভিজাত্যের পরিচায়ক। ঈদের সকালে অভিজাত ঢাকাইয়া পরিবারের খাবার টেবিলে হাতে বানানো সেমাই এখনো পাওয়া যায়। তখনকার দিনে ঢাকায় বিত্তশালীদের বাড়িতে থাকত বৈঠকখানা। 

এই বৈঠকখানায় দিল্লি বা লখনউ থেকে আনা সুগন্ধি ব্যবহার করত অনেকে। গোলাপজল ছিটিয়ে আগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানো হতো এবং ব্যবস্থা করা হতো ব্যয়বহুল ২৪ পদের তোরাবন্দি খাবার। নওয়াব আমলে অভিজাত নাগরিকরা ঈদের দিন বিকেলে মিলিত হতেন ‘আহসান মঞ্জিলে’। বাইশ পঞ্চায়েতের সর্দারদের দাওয়াত করা হতো সে মজলিসে।  

যুগে যুগে ঢাকার ঈদ মিছিল
ঈদ উৎসবের আরেকটি আকর্ষণ ছিল ঈদের মিছিল, যার শুরু সুবাদার ইসলাম খাঁর সময়ে। এই ধারাবাহিকতায় নিমতলী প্রাসাদে বসবাসকালীন নায়েব-নাজিমদের সময়েও অনুষ্ঠিত হতো ঈদের মিছিল। উনিশ শতকের শুরুতে আলম মুসাওয়ার নামে চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবিতে তার প্রমাণ মেলে। নায়েব-নাজিমদের বংশ লুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদের রাজকীয় মিছিল প্রাণস্পন্দন হারায়। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে ঢাকায় আবার ঈদের মিছিল চালু হয়। এই ঈদ মিছিল কখনো হতো ঈদের পরদিন, আবার কখনো বা ঈদের দিন বিকেলে। 

এ প্রসঙ্গে লেখক ও গবেষক রফিকুল ইসলাম রফিক ‘যুগে যুগে ঢাকার ঈদ মিছিল’-এ লিখেছেন, ‘উর্দু রোডের হিন্দু মন্দিরের কাছে থাকত হিন্দু ধোপারা। তারা ঈদের মিছিলে সং সেজে বাদ্যের তালে তালে নেচে নেচে গাইত—

‘আও আও মিলকে চালে হিন্দু-মুসলমান
দুনো হাম হায় পাড়োশি, ঝগড়া কাহেকা
আও আও মিলকে চালে হিন্দু-মুসলমান। ’

ঈদমেলা ও ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা
চকবাজার, রমনা ময়দান, আরমানিটোলা, ধূপখোলা মাঠ, পল্টন ময়দানসহ ঢাকার আরো কয়েকটি জায়গায় ঈদের দিন মেলা বসত। সবচেয়ে বড় মেলাটি বসত চকবাজারে। ঈদের দিন বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হতো গনি মিয়ার হাট, রমনা মাঠ, পল্টন ময়দান, শহীদনগরের চর, কামরাঙ্গীর চর কিংবা নবাববাড়ির মাঠ ও পাকা ঘরের ছাদে। 

নগরায়ণ, আধুনিকায়ন ও বিশ্বায়নের ছোঁয়ায় পুরান ঢাকাবাসীর ঈদ ফ্যাশনে যোগ হয়েছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ঢং। হারিয়ে গেছে কিংবদন্তির হাফিজ মিঞা, মতি খলিফা আর বশিরউদ্দিন। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের ফ্যাশন ও রুচি। কালের পরিবর্তনে শাওয়ালের ঈদ ঢাকাবাসীর কাছে ধর্মীয় বোধের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন উৎসব।


গো নিউজ২৪/এএইচ

এক্সক্লুসিভ বিভাগের আরো খবর
যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিয়ে করতে চান, তাদের যে বিষয়গুলো জেনে রাখা দরকার

যারা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিয়ে করতে চান, তাদের যে বিষয়গুলো জেনে রাখা দরকার

নিরাপদ বিনিয়োগের অপর নাম সঞ্চয়পত্র, কোনটি কিনতে কী কাগজপত্র লাগে

নিরাপদ বিনিয়োগের অপর নাম সঞ্চয়পত্র, কোনটি কিনতে কী কাগজপত্র লাগে

ঢাকা শহরে সব কাজই করেন মেয়র, এমপির কাজটা কী

ঢাকা শহরে সব কাজই করেন মেয়র, এমপির কাজটা কী

নতুন আয়কর আইনে একগুচ্ছ পরিবর্তন

নতুন আয়কর আইনে একগুচ্ছ পরিবর্তন

দলিলের নকলসহ মূল দলিল পেতে আর ভোগান্তি থাকবে না

দলিলের নকলসহ মূল দলিল পেতে আর ভোগান্তি থাকবে না

ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানতকারীদের আয়কর রিটার্ন নিয়ে যা জানা জরুরী

ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানতকারীদের আয়কর রিটার্ন নিয়ে যা জানা জরুরী