ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মৃত্যুরে আমি ভালোবাসি...


গো নিউজ২৪ | পাপলু রহমান, নিউজরুম এডিটর প্রকাশিত: আগস্ট ৬, ২০১৭, ০৭:৫৮ পিএম
মৃত্যুরে আমি ভালোবাসি...

ঢাকা: ‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর
        আজি তার তরে
        ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে
        এত ভালোবাসি
        বলে হয়েছে প্রত্যয়
        মৃত্যুরে আমি ভালো
        বাসিব নিশ্চয়।’

মৃত্যুকে রবীন্দ্রনাথ এভাবে অনেকভাবেই তার লেখায় টেনে এনেছেন। হতে পারে এ চিন্তাটি তাকে গ্রাস করত বারবার। আবার লেখায় যেহেতু কোনো বিষয়ই বাদ পড়েনি তার, মৃত্যুটাইবা কেন বাদ পড়বে? তিনি তো দার্শনিক কবি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অমোঘ এ সত্য তার লেখায় আনবেন না- তা কী হয়!

পথিকেরে কবে/ ভালোবেসে ছিল কবি বেঁচেছিল যবে...

বিশ্বকবি তার জন্মদিনের আড়ম্বর নিয়ে ১৩৪৩ সালে প্রবাসী পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘খ্যাতির কলবরমুখর প্রাঙ্গণে আমার জন্মদিনের যে আসন পাতা রয়েছে, সেখানে স্থান নিতে আমার মন যায় না। আজ আমার প্রয়োজন স্তব্ধতায় শান্তিতে।’ জন্মদিনেই কবি মৃত্যুচিন্তাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

সারাজীবন চিকিৎসকের কাঁচি থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু শেষ অবধি তা যেন সম্ভব হচ্ছিল না। ১৯৪১ সালে এসে জীবনের শেষ দিনগুলোয় অসুখে তাকে ভুগিয়েছিল খুব। তখন ছিলেন শান্তিনিকেতনে। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি চলছিলই, কিন্তু তাতে কিছু হচ্ছিল না।

এরই মধ্যে অবনীন্দ্রনাথ বেশ কিছু গল্প লিখেছেন। সেগুলো পড়ে দারুণ আনন্দ পেলেন কবি। বললেন, আরো লিখতে। অবন ঠাকুর রানী চন্দকে গল্প বলে যান, রানী চন্দ সে গল্প শুনে লিখে ফেলেন। রানী চন্দ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভাজন, শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী ও চিত্রশিল্পী এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দের স্ত্রী। রানী চন্দের লেখার কিছু দেয়া হলো রবীন্দ্রনাথকে। তিনি পড়লেন, হাসলেন এবং কাঁদলেন। রানী চন্দ এই প্রথম এমন করে রবিঠাকুরের চোখ থেকে জল পড়তে দেখলেন।

পথিকেরে কবে/ ভালোবেসে ছিল কবি বেঁচেছিল যবে...

রোগ সারাতে চিকিৎসকেরা কবির অস্ত্রোপচারের পক্ষেই মত দিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের তাতে মত নেই। তিনি বললেন, ‘মানুষকে তো মরতেই হবে একদিন। একভাবে না একভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কি প্রয়োজন?’

কবির মাত্র এক চল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রী বিয়োগ হয়। কবি যখন দূরে থাকতেন স্ত্রী মৃণালিণী দেবীকে ‘ভাই ছুটি’ সম্বোধন করে চিঠি লিখতেন। কবির সেই ‘ছুটি’ যখন সংসার জীবন থেকে সত্যিই একদিন ছুটি নিয়ে চলে গেলেন, তখন তার বয়স মাত্র ঊনত্রিশ। উনিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে পাঁচটি সন্তানের জনক-জননী হয়েছিলেন তারা। তাদের জীবনে একে একে এসেছে, বেলা, রথী, রানির, মীরা ও শমি।

মৃণালিণী দেবির ‘চিরছুটির’ পরপরই তাই লেখেন ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থটি। স্ত্রী বিয়োগের ব্যথা কষ্ট ছড়িয়ে আছে ‘স্মরণ’ কবিতাগুলিতে। যেন নতুন করে মৃণালিনী দেবীকে আবিষ্কার করলেন। মিলন কবিতায় লিখলেন, ‘মিলন সম্পূর্ণ আজি/ হল তোমা-সনে /এ বিচ্ছেদ বেদনার।’ মৃণালিনী দেবীর শেষ বেলার বিদায় মুহূর্তের কথা মনে করেই পরবর্তীতে লিখেছিলেন, ‘দুজনের কথা দোঁহে/ শেষ করি লব/ সে রাত্রে ঘটেনি/ হেন অবকাশ তব।’

‘শেষ কথা’ কবিতায় কবি লিখেছেন- ‘তখন নিশীথরাত্রি,/ গেলে ঘর হতে/ যে পথ চলেনি কভু,/ সে অজানা পথে /যাবার বেলায় কোনো/ বলিলে না কথা/ লইয়া গেলে না কোনো বিদায়বারতা।’

মরণ বলে, আমি তোমায় জীবনতরী বাই...

উৎসবে উৎসবে শান্তিনিকেতনে অনেক বৃক্ষ রোপণ করেছিলেন কবি। বৃক্ষরোপণ নিয়ে লেখা একটি কবিতায়ও দেখতে পাই সেই অনাগত মৃত্যুচেতনার আভাস- ‘হে তরু, এ ধরাতলে/ রহিব না যবে/ সে দিন বসন্তে/ নব পল্লবে পল্লবে/ তোমার মর্মরধ্বনি/ পথিকেরে কবে/ ভালোবেসে ছিল কবি বেঁচেছিল যবে।’ ব্যক্তিজীবনে মৃত্যুকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার আভাস ছড়িয়ে আছে এসব কবিতার ছত্রে ছত্রে।

কবির মৃত্যু উপলব্ধি যে অনেক আগেই হয়েছিল তার আরেকটি উদাহরণ ‘গীতাঞ্জলি’র সেই কয়েকটি লাইন, ‘দিবস যদি সাঙ্গ হল/ না যদি গাহে পাখি/ ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে/ এ বার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি।’

কবি কিশোর বয়সে বন্ধুপ্রতিম বৌদি কাদম্বরী দেবীর অকালমৃত্যু, আরো পরে এসে স্ত্রীর মৃত্যু- তারপর একে একে প্রিয়জনদের চলে যাওয়ার নীরব সাক্ষী। কবির এসব মৃত্যুশোক উপলব্ধি তাকে এক অনন্য অভিজ্ঞতা দিয়ে সহায়ক হয়েছিল। জীবনস্মৃতিতে ‘মৃত্যু শোক’ পর্যায়ে অকপটে তাই লেখেন, ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড়ো মনোহর।’

মৃত্যুকালীন রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে রচনা করা কিছু অবিস্মরণীয় পঙক্তিমালা। যেমন- মরণের মুখে রেখে দূরে, যাও দূরে যাও চলে/ মরণ বলে, আমি তোমায় জীবনতরী বাই/ আবার যদি ইচ্ছা করে আবার আসি ফিরে/ পেয়েছি ছুটি বিদায়/ দেহো ভাই/ সবারে আমি প্রণাম করে যাই/ ফিরায়ে দিনু ঘরের চাবি/ রাখি না আর ঘরের দাবি/ সবার আজি প্রসাদ বাণী চাই/ আবার যাবার বেলাতে সবাই জয়ধ্বনি কর/ জানি গো দিন যাবে/ এ দিন যাবে/ একদা কোনো বেলা শেষে/ মলিন রবি করুণ হেসে/ শেষ বিদায়ের চাওয়া/ আমার মুখের পানে চাবে।

তোমার সৃষ্টির পথ/ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে...

চিরছুটির মাত্র সাত দিন আগেও কবি ছিলেন সৃষ্টিশীল। শেষ বিদায়ের দিন কয়েক আগে চৌদ্দ শ্রাবণ। রানী চন্দ সেদিন লিখেও নেন রবীন্দ্রনাথের শেষ লেখা কবিতাটি, ‘তোমার সৃষ্টির পথ/ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে,/ হে ছলনাময়ী।’

দুদিন পর ১৬ শ্রাবণ কবির হিক্কা শুরু হয়। কাতর স্বরে উপস্থিত সবাইকে বললেন, ‘একটা কিছু করো, দেখতে পাচ্ছো না কী রকম কষ্ট পাচ্ছি।’ পরের দিন হিক্কা থামানোর জন্য ময়ূরের পালক পুড়িয়ে খাওয়ানো হলেও তাতে কিছুমাত্র লাঘব হল না।

এরপর ১৮ শ্রাবণ কিডনিও নিঃসাড় হয়ে পড়লো। তিনদিন পর ২১ শ্রাবণ রাখি পূর্ণিমার দিন কবিকে পূবদিকে মাথা করে শোয়ানো হল। পরদিন ২২ শ্রাবণ, ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে মন্ত্র জপ করা হলো ব্রাহ্ম মন্ত্র- ‘শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম..’, ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়..।’ রবীন্দ্রনাথ তখন মৃত্যু পথযাত্রী। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ঘড়িতে তখন বেলা ১২টা বেজে ১০ মিনিট।

গোনিউজ/এন

সাহিত্য ও সংষ্কৃতি বিভাগের আরো খবর
‘ছি ছি ছি ছি’ দুয়োধ্বনি দিয়ে বইমেলা থেকে বিতাড়িত মুশতাক-তিশা!

‘ছি ছি ছি ছি’ দুয়োধ্বনি দিয়ে বইমেলা থেকে বিতাড়িত মুশতাক-তিশা!

৭৬ বছরে এসে কবি হেলাল হাফিজ বললেন, ‘একা থাকার সিদ্ধান্ত ছিলো ভুল’

৭৬ বছরে এসে কবি হেলাল হাফিজ বললেন, ‘একা থাকার সিদ্ধান্ত ছিলো ভুল’

বইমেলায় এসেছে ডিআইজি (প্রিজন্স) জাহাঙ্গীর কবিরের বিচিত্র কয়েদখানা

বইমেলায় এসেছে ডিআইজি (প্রিজন্স) জাহাঙ্গীর কবিরের বিচিত্র কয়েদখানা

বীর মুক্তিযোদ্ধা রাতুল কৃষ্ণ হালদার এর দুটি বই এবারের বই মেলায়

বীর মুক্তিযোদ্ধা রাতুল কৃষ্ণ হালদার এর দুটি বই এবারের বই মেলায়

এবার একুশে পদক পাচ্ছেন যারা

এবার একুশে পদক পাচ্ছেন যারা

যাত্রাপালার ইতিহাস

যাত্রাপালার ইতিহাস