ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিজ দেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিলেন যে শাসক


গো নিউজ২৪ | রাশেদ শাওন প্রকাশিত: মে ২৯, ২০১৭, ০১:৩১ পিএম আপডেট: মে ২৯, ২০১৭, ০৮:৫২ এএম
নিজ দেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিলেন যে শাসক

রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন ১৯২৪ সালে মারা যাওয়ার পর তার উত্তরসূরি হিসেবে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন জোসেফ স্ট্যালিন। ওই সময়টা খুব একটা ভালো পরিস্থিতি যাচ্ছিলো না সোভিয়েত সাম্রাজ্যের। স্ট্যালিন ক্ষমতায় আসার পর তাকে ব্যস্ত থাকতে হয় বিভিন্ন প্রতিবিপ্লবী ও কমিউনিস্ট-বিরোধী সংগঠনগুলোর মোকাবেলায়। ১৯৩২ সালের মধ্যে মধ্য-এশিয়ার দেশগুলোকে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক এই স্বৈরশাসক।

এই সময়ের মধ্যে স্ট্যালিনের প্রকৃত শত্রুর বাইরেও গজিয়ে ওঠে অনেক কাল্পনিক শত্রু। অনেকের জনপ্রিয়তা অসহ্য হয়ে ওঠে স্ট্যালিনের কাছে। এক পর্যায়ে সোভিয়েত সাম্রাজ্যে তিনি শুরু করেন স্ট্যালিন-বিরোধীদের নির্মূল অভিযান। এর নাম দেয়া হয় ‘গ্রেট পার্জ’। গ্রেট পার্জ কথাটির অর্থ মহাশুদ্ধিকরণ। কেউ কেউ একে ‘গ্রেট টেরর’ বা মহাসন্ত্রাস বলেও আখ্যা দেন। অনেকে গ্রেট পার্জকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘গ্রেট সিন’ বা ‘মহাপাপ’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন।

১৯৩৬ সালে মূলত রাজনৈতিক দমন অভিযান গ্রেট পার্জ শুরু করেন স্ট্যালিন। চলে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। অভিযান চালানো হয় কমিউনিস্ট পার্টি, লাল ফৌজ ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে। গ্রেট পার্জ মানেই ছিল গ্রেপ্তার, নির্যাতন, নির্বাসন আর খুন। প্রকৃত কিংবা কল্পিত- যেকোনো শত্রুকে ধরেই হয় তাকে পাঠনো হতো নির্বাসনে, অথবা ধুকে ধুকে মরতে হতো জেলখানায়। আর তা না হলে স্ট্যালিন বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারাতে হতো তাকে।

১৯৩৬ সালে শুরু হলেও গ্রেট পার্জের মূল অভিযানটি ছিল ১৯৩৭ এবং ১৯৩৮ সালজুড়ে। এই সময়ের মধ্যে ছয় থেকে ১২ লাখ লোককে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মধ্যমে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ছিল লেনিনের খুব কাছের কিছু রাজনৈতিক সহকর্মী। প্রতিবিপ্লবী এবং জনগণের শত্রু  আখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয় তাদের। স্ট্যালিনের গ্রেট পার্জ অভিযানকে বাস্তবায়ন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপন পুলিশ বাহিনী এনকেভিডি, যার অগ্রনায়ক ছিলেন নিকোলাই ইয়েজভ।

এভাবেই হত্যা করা হতো স্ট্যালিন-বিরোধীদের

সর্বপ্রথম স্ট্যালিনের গ্রেজ পার্জ পরিকল্পনার কথা টের পান লেনিনের বিপ্লবী বাহিনী রেড আর্মির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ট্রটস্কি। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে মেক্সিকো চলে যান। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। ১৯৪০ সালে শুদ্ধি অভিযানের সমাপ্তি পর্বে মেক্সিকোর একটি লাইব্রেরিতে আততায়ীর হাতে প্রাণ হারান ট্রটস্কি। তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত হানা হয়। রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি ও লেনিনের স্ত্রী নাদেজদা স্ক্রপস্কায়াকে আমৃত্যু গৃহবন্দি করে রেখেছিলেন স্ট্যালিন।

মূলত ১৯৩৫ সালে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয় নেতা সার্গেই কিরভকে হত্যার মধ্য দিয়ে গ্রেট পার্জের সূচনা করেছিলেন স্ট্যালিন। ট্রটস্কি পালিয়ে যাবার পর লেনিনগ্রাদের কমিউনিস্ট নেতা সার্গেই কিরভ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দলে। কিন্তু ১৯৩৪ সালে তাকে লেনিনগ্রাদের স্মোলনি ইনস্টিটিউটে গুলি করে হত্যা করা হয়। এটা পরিষ্কার ছিলো যে কাজটা স্ট্যালিনের। তবে স্টালিন এর দায় চাপায় তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর। কিরভের কফিন বহন করে সবাইকে স্ট্যালিন বুঝান যে, তিনি কী মর্মাহত!

১৯৩৬ সালে শুরু হলেও ১৯৩৭ এবং ১৯৩৮ সাল ছিল গ্রেট পার্জের সবচেয়ে ভয়াবহ সময়। এমনকি ১৯৩৯ সালেও এই অভিযানের রেশ থেকে যায়। ওই বছর অনেক বিজ্ঞানী, উদ্যানবিদ, কবি, সুরকারকে শুদ্ধি অভিযানের শিকার হতে হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্ট্যালিনের নির্দেশে যে এনকেডিভি প্রধান নিকোলাই ইয়েজভ অসংখ্য লোককে হত্যা করেছেন, ১৯৩৯ সালে তাকেই হত্যার নির্দেশ দেন স্ট্যালিন। ইয়াজভকে হত্যার পর বাহিনীর প্রধান হন কুখ্যাত লাভরেন্তি। স্ট্যালিনের মৃত্যু পর্যন্ত পদে বহাল ছিলেন তিনি।

স্ট্যালিন ক্ষমতায় আসার পর ৫৮ ধারা নামের একটি আইন তৈরি করেন। আর সেই কালাকানুনের বলেই লাখ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। এই সময়ে স্ট্যালিন হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর থেকেই মূলত বলশেভিকদের রাজনৈতিক শত্রুদের দমন পীড়ন শুরু করেন লেনিন। স্ট্যালিনের সময়ে এসে তা আরো তীব্র রূপ ধারণ করে।

গণহত্যার আরেকটি দৃশ্য

লেনিনের প্রতিষ্ঠিত রেড আর্মিতেও ‍শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিলেন স্ট্যালিন। ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ রেড আর্মি কর্মকর্তা শিকার হয়েছিলেন এই নিপীড়নের। এছাড়া লেলিনের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে এবং সরকারে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের প্রায় সবাইকেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন স্ট্যালিন। তিনি একাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বেসর্বা হতে চেয়েছিলেন। ১৯২০ এবং ত্রিশের দশকজুড়ে ২ হাজার লেখক, শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীকে গ্রেপ্তার করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে, যাদের মধ্যে দেড় হাজারই কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।

গ্রেট পার্জের যারা শিকার হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়াও অন্য দেশের নাগরিকও ছিল। ফিনল্যান্ড বংশোদ্ভূত ১৪১ মার্কিন নাগরিক এবং ১২৭ কানাডীয় নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল এই সময়। ১৯৩৯ সালে এসে গ্রেট পার্জ শেষ হলেও স্ট্যালিনের মৃত্যু পর্যন্ত গণগ্রেপ্তার ও নির্বাসন দেয়ার কাজ চলতে থাকে। গ্রেট পার্জের সময় মোট কত লোক নিহত হয়েছিল তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন নথিপত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ১৯৩৭ এবং ১৯৩৮ সালে ১৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩৬৬ জনকে গ্রেপ্তার করে এনকেডিভি, যার মধ্যে ৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৯২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১ হাজার লোককে হত্যা করতো স্ট্যালিনের বাহিনী।

গবেষক আলেকজেন্ডার ওয়েসবার্গ-চিবুলস্কির তথ্যমতে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যার সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ লোককে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়া গ্রেপ্তার করা হয়েছিল মোট ৮০ লাখ লোককে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানার সংখ্যা অনুসারে এই হিসাব করেছেন আলেকজেন্ডার ওয়েসবার্গ-চিবুলস্কি।

স্ট্যালিনের বন্দিশিবির

অনেক গবেষকই মনে করেন, সোভিয়েত সরকারের নথিপত্রে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা প্রকৃত তথ্যের চেয়ে অনেক কম। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন ইতিহাসবিদ রবার্ট কনকিওয়েস্ট’র মতে, গ্রেট পার্জের সময় মৃতের সংখ্যা ৬ লাখ ৮১ হাজার ৬৯২ জন নয়; বরং এর চেয়ে আড়াইগুণ বেশি হবে।

এছাড়া আরেক ইতিহাসবিদ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন বিষয়ক গবেষক মাইকেল অ্যালমানের তথ্য মতে, গ্রেট পার্জের দুই বছরে সোভিয়েত ইউনিয়নে মোট সাড়ে নয় লাখ থেকে ১২ লাখ লোককে হত্যা করা হয়। স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর অনেক জায়গায় আবিষ্কৃত সোভিয়েত আমলের গণকবরে পাওয়া যায় গ্রেট পার্জের চিহ্ন।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হয় সেই গ্রেট টেরর, তথা গ্রেট পার্জ। ২৯ বছর ধরে প্রবল প্রতাপে দেশ চালান তিনি। ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিন মৃত্যুবরণের পর আবার সোভিয়েত ইউনিয়নে শুরু হয় ‘ডি-স্ট্যালিনাইজেশন’ বা স্ট্যালিনমুক্তকরণ প্রক্রিয়া। এই সময়ে স্ট্যালিনের অনেক সমর্থককে দেয়া কারাদণ্ড। অনেককে ঝুলানো হয় ফাঁসিতে।

গো নিউজ২৪/ আরএস

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর
বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত সহজ করতে চালু হচ্ছে অন অ্যারাইভাল ভিসা

বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত সহজ করতে চালু হচ্ছে অন অ্যারাইভাল ভিসা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও