ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘুমের ট্যাবলেট-বন্দী জীবনই তাদের শেষ ভরসা


গো নিউজ২৪ | আরিফ আহমেদ সিদ্দিকী, জেলা প্রতিনিধি প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০১৭, ১০:৪৩ এএম
ঘুমের ট্যাবলেট-বন্দী জীবনই তাদের শেষ ভরসা

পাবনা: মানসিক রোগ নিরাময়ের জন্য সারাদেশে একনামেই পরিচিত 'পাবনা মানসিক হাসপাতাল'।  বিশেষায়িত হাসপাতাল হলেও শুরু থেকে এখন অবধি লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া।  হয়নি কোনো উন্নয়ন বা আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা। 

মানসিক রোগ নিরাময়ে রোগীদের প্রয়োজন সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা। অথচ গত ছয় দশকেও নেই কোনো চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। ওষুধ সেবন ছাড়া যেন আর কোনো কাজ নেই রোগীদের। তবে কোনো রোগী যদি চিকিৎসক বা নার্সদের কথা না শুনে তাহলে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন।  নির্যাতনের মাত্রা লঘু থেকে গুরুতর পর্যায়েও চলে যায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের মানসিক রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের শীতলাই হাউজে অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয় পাবনা মানসিক হাসপাতাল। এর দুই বছর পর ১৯৫৯ সালে শহরতলীর হেমায়েতপুরে ১১১ দশমিক ২৫ একর জায়গার উপরে স্থানান্তর করা হয় হাসপাতালটি। প্রাথমিক অবস্থায় হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ছিল ৬০টি। সময়ের চাহিদায় যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০ শয্যায়। 

এদিকে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ওষুধ চুরিসহ নানা অনিয়ম আর অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালটির বিরুদ্ধে।  এছাড়া প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এলেও বাড়েনি চিকিৎসা সেবার মান। অথচ এটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নামেই খ্যাত। মানসিক রোগী মানেই এক একটি জীবনের বাস্তবধর্মী গল্প। যেখানে জীবন মানেই হতাশা। আর স্বপ্ন মানেই সুস্থ হয়ে আপনজনের কাছে ফিরে যাওয়া। কিন্তু এই হাসপাতালের বর্তমান অবস্থা বিপরীত। 

চিকিৎসা সেবার মানতো বাড়েইনি। উল্টো চিকিৎসা মানেই হাসপাতাল ওয়ার্ডে বন্দী জীবনযাপন। রোগী কখনো বিরক্তের কারণ হলেই তার ওপর চালানো হয় ঘুমের ওষুধ। আর ওই ওষুধ না খেতে চাইলে তার ওপর করা হয় নির্যাতন।  এভাবেই অসহায় এই রোগীগুলোকে দিনের পর দিন সইতে হয় কঠিন নির্যাতন। 

হাসপাতালের ওয়ার্ডে থাকা একাধিক রোগী ছুঁটে আসে একদণ্ড কথা বলার জন্য।  নানাজনে নানা ভাবে তার অভিযোগ মনের কথা নানা ভঙ্গিমায় প্রকাশ করেন।  এক রোগীর কাছে যেতেই তিনি জানান, বেশি কথা বললে তাকে ঘুমের ট্যাবলেট  খাওয়ানো হয়।  কথা না শুনলে মারে।

হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমান রোগীর স্বজনরা বলেন, ‘এটি মানসিক হাসপাতাল! তবে মনের চিকিৎসার হাসপাতাল এটি নয়। ’

অভিভাবক ও রোগীদের অভিযোগ, কখনো ওয়ার্ডে ডাক্তার আসেননা।  বিপুল পরিমাণ জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে।  অথচ বিনোদনের জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। নেই কোনো ফুলের বাগান। 

গান গাইতে গাইতে এক রোগী এসে বলেন, ‘আরে আমি তো আড়াই মাস আইলাম।  তয় ডাক্তার কেডা তারেই চিনলাম না। ’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, যারা মানসিক রোগী।  তাদের প্রতিদিন ফলোআপের প্রয়োজন পড়ে না। পাশাপাশি পদ না থাকায় রোগীদের কাউন্সিলিং ও মনস্তাত্ত্বিক সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। 

তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, এসব চিকিৎসা ছাড়া কখনই মানসির রোগীদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয়। 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘যেখানে মানসিক এবং সামাজিক চিকিৎসা হবে না, শুধুমাত্র আমরা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করে যাব, সেখানে এই চিকিৎসাটা অপূর্ণ থেকে যাবে। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে আমাদের।’

এদিকে পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস বলেন, ‘এটা তো সাইকাইয়াট্রি হাসপাতাল, এখানে প্রতিদিন ফলোআপের দরকার হয় না। চিকিৎসক বাড়ানোর পাশাপাশি একটি হাফওয়ে হাউজ নির্মাণ করা গেলে ৫শ শয্যার ওপর চাপ কমবে। ’

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ‘চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রের অবস্থা এমন শোচনীয় হবে কেন? শুধু ওষুধ দিয়ে, বন্দী জীবনের মধ্যে থেকে কখনোই মানসিক রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন মুক্ত পরিবেশ। 

এদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, হাসপাতালের মোট ৫৪২টি মঞ্জুরিকৃত পদের মধ্যে ১৮৯টি পদ শূন্য রয়েছে। এদের মধ্যে চিকিৎসকের ৩০টি পদের মধ্যে ২৪টি শূন্য, প্রথম শ্রেণির অন্যান্য ৭টি পদের মধ্যে ২টি শূন্য, দ্বিতীয় শ্রেণির ১৯৬টি পদের মধ্যে ৩৬টি শূন্য, তৃতীয় শ্রেণির ১১৯টি পদের মধ্যে ২২টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ১৭০টি পদের মধ্যে ৬৭টি পদ শূন্য। শূন্যপদের মধ্যে সিনিয়র কনসালটেন্ট ২টি, ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট ১টি, ক্লিনিক্যাল অ্যাসিস্টেন্ট ৭টি, মেডিকেল অফিসার ৪টি, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার ১টি, সহকারী রেজিস্ট্রার ২টি, এসএলপিপি ১টি, ডেন্টাল সার্জন ১টি, অ্যানেসথেটিস্ট ১টি, আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট ১টি, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিস্ট ১টি, বায়োকেমিস্ট ১টি, সিনিয়র স্টাফ নার্স ১৬টি, স্টাফ নার্স ১৮টি, সহকারী নার্স ৬টি, লন্ড্রি সুপারভাইজার ১টি, ড্রাইভার ১টি, সহকারী অকুপেশনাল থেরাপিস্ট ৫টি, স্টেনোগ্রাফার ১টি, ইমাম ১টি, অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক ৩টি, ইইজি টেকনিশিয়ান ১টি, টেলিফোন অপারেটর ১টি, এমএলএসএস ২৩টি, ওয়ার্ডবয় ৩৫টি, কুক মশালচী ৬টি, মালি ৩টি, সুইপার ১৪টি পদ খালি রয়েছে অনেক দিন ধরে। এতগুলো পদ শূন্য থাকায় ৫০০ জন মানসিক রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এদিকে এক শ্রেণির দালালচক্রের মাধ্যমে হাসপাতালের আশপাশে গড়ে উঠা ক্লিনিকগুলো হাতিয়ে নিচ্ছে সুযোগ। তাদের নিয়োগকৃত দালালদের কাছে নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছেন চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা। হাসপাতাল ক্যাম্পাসে এক রোগীর স্বজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে মানসিক রোগীদের সেবার নামে চলছে রমরমা ব্যবসা। রোগীদের খাবার, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে রয়েছে তাদের বিস্তর অভিযোগ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত টাকার অর্ধেকও রোগীদের পিছনে খরচ করা হয় না। 

হাসপাতাল থেকে জানা যায়, পরিবারের লোকজনের অবহেলা আর উদাসীনতার কারণে ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে ভর্তি হওয়া ২১ জন রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পরও বাড়ি ফিরতে পারছেন না।  সুস্থ হওয়ার পরও তাদের থাকতে হচ্ছে অসুস্থদের সাথে। এদের মধ্যে ঢাকা সবুজ বাগের বদিউল আলম, চুয়াডাঙ্গার আশরাফুজ্জামান মিন্টু, রাজশাহীর বোয়ালিয়ার ইতেমাতুদ্দৌলা, ঢাকা মিরপুরের কাজী আকরামুল জামান, ঢাকা মগবাজারের সাঈদ হোসেন, ঢাকা ধানমন্ডির মাহবুব আনোয়ার, পাবনা নাজিরপুরের মিনহাজ্ব উদ্দিন, ঢাকা শাঁখারী বাজারের শিপ্রা রানী, ভুল ঠিকানায় ছকিনা খাতুন, জাকিয়া সুলতানা, ডলি খাতুন, গোলজার বিবি পলু, কাজী খোদেজা, আরজু বেগম, নাজমা আক্তার, নাঈমা চৌধুরী, শাহানা আক্তার, নাজমা নিলুফা, আমেনা খাতুন বুবি, সাহিদা খাতুন রয়েছেন। 

হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স নার্গিস সুলতানা জানান, পৃথিবীটা বড় আজব জায়গা। সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা এবং পরিবারের বোঝা ভেবেই সুস্থ হওয়া সত্ত্বেও এদের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে না তাদের স্বজনেরা। এদের নিয়ে গেলে আরও নতুন ২১টি রোগী সিট পেত।  কিন্তু এদের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।  

এদিকে এসব সুস্থ রোগীদের বাড়ি ফিরে নিতে হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট মেসবাউল ইসলাম ২০১৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। তার রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মানসিক হাসপাতালের পরিচালককে এদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।

এসব বিষয়ে কথা বলতেই পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তন্ময় প্রকাশ বিশ্বাস জানান, মাত্র ৫ জন ডাক্তার দিয়ে কীভাবে ৫শ বেডের একটি হাসপাতাল চলে? চাহিদা অনুযায়ী সেবা নিতে আসা রোগীদের কাঙিক্ষত সেবা দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

পাবনার সচেতন মহল মনে করেন বর্তমান সরকার পাবনার মানসিক হাসপাতালের দিকে বিশেষ নজর দিবেন। হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী ডাক্তার, কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে এবং অবকাঠামোর মান উন্নয়ন করে মানসিক সেবার মান নিশ্চিত করবেন। এটাই পাবনাবাসীর প্রত্যাশা। 

গোনিউজ২৪/এমবি
 

দেশজুড়ে বিভাগের আরো খবর
মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কোটি টাকা নিয়ে পালালো ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট

মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কোটি টাকা নিয়ে পালালো ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট

দিনের শুরুতেই বিআরটিসি বাসের চাপায় নিহত ৪ 

দিনের শুরুতেই বিআরটিসি বাসের চাপায় নিহত ৪ 

ধারের টাকা দিতে না পারায় বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ে

ধারের টাকা দিতে না পারায় বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ে

বোমাটি বিস্ফোরিত হলে বাসের সবাই মারা যেতেন

বোমাটি বিস্ফোরিত হলে বাসের সবাই মারা যেতেন

রেললাইনে বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা, হাতেনাতে আটক ৩

রেললাইনে বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা, হাতেনাতে আটক ৩

হাতকড়া পরা অবস্থায় বাবার জানাজায় বিএনপি নেতা

হাতকড়া পরা অবস্থায় বাবার জানাজায় বিএনপি নেতা