যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ১৪০ বছরের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে যা ঘটেনি, তা-ই ঘটতে চলেছে। মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট কমিটি যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবে, তার একটা আভাস গত ৬-৮ মাস ধরে শোনা যাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত যে মাইক ব্রিয়ারলি, রডনি মার্শ, রামিজ রাজারা নিয়ে ফেলবেন সেই সিদ্ধান্ত তা অনেকেই আন্দাজ করে উঠতে পারেননি।
মাঠে অসভ্যতার পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে আম্পায়াররা লাল কার্ড দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট ক্রিকেটারকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেবেন। ঘার ধাক্কা দিয়ে এভাবে একজন ক্রিকেটারকে মাঠের বাইরে আগে কখনও পাঠানো হয়নি। হবে এই প্রথম। জাভেদ মিয়াদাদ বনাম ডেনিস লিলির হাতাহাতির সময়েও আম্পায়াররা কাউকে মাঠের বাইরে চলে যেতে বলেননি।
এম সি সি ক্রিকেট কমিটি এখানে দুদিনের সভায় যে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তের প্রস্তাব করল, তা আই সি সি মেনে নিলে, সত্যি সত্যি এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি হবে। ক্রমাগত মাঠে অসভ্যতা বাড়ছে। এই অসভ্যতার হাত থেকে বাঁচার জন্য কিছু একটা করার দরকার ছিল। এম সি সি তা করার জন্য উদ্যোগ নিল অবশেষে। ব্রিয়ারলি জানালেন, ‘লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়া ক্রিকেটার ওই ম্যাচে আর মাঠে ফিরতে পারবেন না। ফুটবলের নিয়মকে অনুসৃত করা হবে। তবে, ফুটবলের মতো হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্ক করার নিয়ম থাকছে না।
কী কী কারণে একজন ক্রিকেটারকে লাল কার্ড দেখানো হবে?
১. আম্পায়ারের দিকে তেড়ে যাওয়া, হুমকি দেওয়া,
২. কোনও ক্রিকেটার, আম্পায়ার, কর্মকর্তা বা দর্শকের গায়ে হাত তোলা,
৩. এছাড়া মাঠের ভিতরে তীব্র খারাপ আচরণের মাধ্যমে ক্রিকেটের শিষ্টাচার নষ্ট করা।
লাল কার্ড না দেখিয়ে, পেনাল্টি হিসেবে রান কেটে নেওয়া, আর্থিক জরিমানা করা, এসব ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণ বিশৃঙ্খল হয়ে উঠছে একালের ক্রিকেটাররা, তা কমানোর উদ্দ্যেশ্যে লাল কার্ড দেখানোটাই সেরা রাস্তা বলে মনে করলেন ব্রিয়ারলিরা। অভিনব সিদ্ধান্ত তো বটেই। শেষপর্যন্ত দেখার এমন প্রস্তাবে শিলমোহর দেয় কিনা আই সি সি।
বলের চামড়া তোলা—
এটাই একটা মহামারীর মতো। ওয়াসিম আক্রাম, ওয়াকার ইউনিসরা প্রথমে চামড়া তুলে রিভার্স সুইং করানোর যে রাস্তা দেখিয়েছিলেন তা ক্রমশ ছোঁয়াচে রোগের মতো ক্রিকেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু, এব্যাপারে এম সি সি`র ক্রিকেট কমিটির সদস্যরা কোনও পরিবর্তন আনতে চাইলেন না।
এব্যাপারে মাইক ব্রিয়ারলির বক্তব্য এরকম, ‘ধরা পড় না।’ তার মানে? চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড় ধরা। আমরা একটু অবাকই হলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি যোগ করলেন, ‘থুতু লাগিয়ে বলের পলিশ অক্ষুন্ন রাখা এক সত্যিকারের বড় শিল্প। আমরা চাইনা এই শিল্পকে নষ্ট হতে দিতে।’ প্রশ্ন করা হয়েছিল ব্রিয়ারলির বাঁদিকে বসা রামিজ রাজাকে। তিনি তখন পাকিস্তানের অধিনায়ক এবং তাঁর মস্তিষ্কেই আক্রাম, ইউনিসরা বলের চামড়া তুলে রিভার্স সুইং করিয়েছিলেন। রামিজের জবাব, ‘আমরা ছোট থেকে বড় হয়েছি বলের চামড়া তুলে। কিন্তু কখনো শুনিনি মুখের ভিতরে লজেন্স বলে লাগিয়ে বাড়তি সুইং করানোর পরিকল্পনা।’ মানে বুঝিয়ে দিলেন, বলের চামড়া তোলাটা অন্যায় নয়। কিন্তু লজেন্স লাগানোটা অন্যায়। এবং আবারও ব্রিয়ারলি আরও এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ভাই চুরি চালিয়ে যাও। দেখো যেন ধরা না পড়। ধরা পড়লে তো কড়া শাস্তি পেতেই হবে।’
হেলমেটে বল লাগা—
ফিল্ডারের হেলমেটে বল লেগে ক্যাচ ধরলে বা স্ট্যাম্প করলে তা বৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এখন এমনও হচ্ছে, উইকেটকিপারের প্যাডে লাগা বল ক্যাচ বৈধ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এমনকী স্ট্যাম্পিংও বৈধ। এম সি সি`র ক্রিকেট কমিটি মনে করছে ফিল্ডারের হেলমেটে লাগা বল ক্যাচ হিসেবে গণ্য করা উচিত হবে না। তেমনি উইকেটকিপারের প্যাড, ফিল্ডারের শোয়েটার বা পকেটে লাগা বল ক্যাচ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত নয়। এখন দেখা যাক আই সি সি এই প্রস্তাবটা মেনে নেয় কিনা।
চারদিনের টেস্ট—
ধুকতে থাকা টেস্ট ম্যাচগুলোকে আবার প্রাণ সঞ্চয় করতে চাওয়ার লক্ষ্যে এম সি সি চাইছে পাঁচদিনের পরিবর্তে চারদিনে যাতে টেস্ট ম্যাচ শেষ হয়। খেলা শুরু হোক বুধবার। যা কিনা শেষ হবে শনিবারে। টেস্ট ম্যাচে মাঠে লোক হবে বেশি ছুটি থাকার কারণে। টিভি সম্প্রচার কোম্পানি চারদিনের খরচের জন্য বাজেট কমবে। সামগ্রিকভাবে একটা লম্বা সিরিজ অনেক কম দিনে শেষ হয়ে যাবে। প্রতিটি দল যখন চারদিনের টেস্টে জিততে চাইবে তখন অনেক উত্তেজনা তৈরি হবে। সাহসী হতে হবে অধিনায়ককে। ফলে অনেকে অপ্রত্যাশিত ইনিংস ডিক্লেয়ার করার চেষ্টা করবে। এবং কম শক্তিশালী দলগুলো ম্যাচ বাঁচানোর জন্য যে লড়াই করবে তাও কিন্তু হয়ে উঠবে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বাড়বে উত্তেজনা, মাঠে আসবে অনেক লোক, টেস্ট ক্রিকেটকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এমন ভাবনার আশ্রয় নিতে চাইছে এম সি সি।
অলিম্পিকে ক্রিকেট—
গোটা পৃথিবীতে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দিতে পারে অলিম্পিকের মঞ্চ। তাই এম সি সি প্রস্তাব দিয়েছে অলিম্পিকে টি২০ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা চালু করার ব্যাপারে আইসিসিকে উদ্যোগ নিতে। এমনকী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনেও ক্রিকেটের বিশাল প্রসারের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হল।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ—
টেস্ট ক্রিকেটকে বাঁচানোর জন্য আরও একটি পরিকল্পনাকে দ্রুত বাস্তবায়িত করার পরামর্শ দিল এই সভা। প্রতিটি ক্রিকেট খেলিয়ে দেশকে নিয়ে অবিলম্বে একটি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চালু করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ব্যাটের আকৃতি—
ডেভিড ওয়ার্নার এবং খোয়াজা সবচেয়ে চওড়া ব্যাট ব্যবহার করছিলেন। ৫০ মিলিমিটার। ক্রিকেট ব্যাটকে যাতে তক্তা হিসেবে ব্যবহার না করতে পারেন ক্রিকেটাররা, তাই এই কমিটি ব্যাটের চওড়া ভাবটা কমানোর পরামর্শ দিচ্ছে। ৪০ মিলিমিটারের বেশি চওড়া হবে না। এবং পিছন দিকের কার্ভকে রাখতে হবে ৬৭ মিলিমিটারের মধ্যে।
এমসিসি চাইছে ২০১৭ সালের ১ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রস্তাবগুলোকে কার্যকর করতে। কেন লাগবে আরও দশ মাস? জবাবে রিকি পন্টিং বললেন, ‘ব্যাট প্রস্তুকারক কোম্পানির সঙ্গে, আমরা এব্যাপারে কথা বলেছি। ব্যাটের আকৃতির এই প্রয়োজনের জন্য এই সময়টুকু ওদের দিতেই হবে।
গো নিউজ২৪/এএফ