ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘ওকে কি করে বুঝাই যে ওর বাবা বেঁচে নেই’


গো নিউজ২৪ | নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০১৭, ০৯:৩৯ পিএম
‘ওকে কি করে বুঝাই যে ওর বাবা বেঁচে নেই’

নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলায় নিহত মো. ইব্রাহিমের হত দরিদ্র পরিবারের দিন কাটছে অভাব-অনটনে। পৈত্রিক সম্পত্তির এক খন্ড জমির উপর দু-চালা জরাজীর্ণ একটি ঘরে তার সন্তানরা সহ দুই স্ত্রী মোট ৭ সদস্যের বড় পরিবার বসবাস করছে। পরিবারে আয়-রোজগারের কেউ নেই, তাই ইব্রাহিমের শ্বশুর বাড়ির সাহায্যে সংসার দুটো কোন রকমে দিন কাটাচ্ছে। নিহত ইব্রাহিমের জন্য কান্না করতে করতে তার স্বজনদের চোখের পানি এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে, তাই তার কথা ভাবতেই বুকের ভেতরে চাপা কষ্ট অনুভূত হলেও এখন আর চোখে জল আসে না।

সোমবার (২১ আগস্ট) দুপুরে সরেজমিনে সোনারগাঁ উপজেলার বারদী ইউনিয়নের আলগীর চর পশ্চিম পাড়ায় মো. ইব্রাহিমের বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সাথে কথা বললে তারা গোনিউজ প্রতিবেদককে এসব কথা বলেন।

নিহত মো. ইব্রাহিম (৩৫) সোনারগাঁ উপজেলার বারদী ইউনিয়নের আলগীর চর পশ্চিম পাড়ার আব্দুল ওহাব মিয়ার ছেলে। পারিবারিক ভাবে প্রথম বিয়ে করলেও পড়ে ভালোবেসে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী মাহমুদা বেগমের দুই সন্তান। তারা হলো ইসমাইল হাসান রনি (১৭) ও সীমা আক্তার (১৮)। ইসমাইল হাসান রনি বারদী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে মানবিক বিভাগের ছাত্র। ক্লাস রোল-৩। রনি স্কুলে পড়ালেখা করলেও ছোট বোন সীমা আক্তার মাদ্রাসায় পড়েন। 

পরিবারে বড় সন্তান হওয়ায় ইব্রাহিমই মা-বাবা ও প্রথম স্ত্রীর জন্য সংসারে খরচ দিতো। আরো দুই ভাই থাকলেও তারা তাদের সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। বাড়িতে জমি সংক্রান্ত বিরোধ থাকায় নিহত হওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই চন্দন সরকারের গাড়ি চালক হিসাবে দ্বিতীয় স্ত্রী হুনুফা বেগমকে নিয়ে জালকুড়ি এলাকায় চন্দন সরকারের বাড়ির নিচ তলায় বসবাস করতো মো. ইব্রাহিম। 

ইব্রাহীমের দ্বিতীয় স্ত্রী হনুফা বেগম জানান, ‘আমাদের ১২ বছরের সংসারে দুটি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। আমার স্বামীকে খুন করার পর থেকে এই ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। ছেলেটা খুব ছোট বলে কাজ-কর্মও করতে পারে না। তাই বাপের বাড়ি থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে কোন রকমে দিন কাটাচ্ছি। তবে সন্তানদের পড়াশোনা আর ভরন-পোষনের খরচ চালানো খুবই কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছে। তাই মেয়ে দুটোকে মাদ্রাসার এতিম খানায় দিয়ে দিয়েছি। ওর বাবার আশা ছিল মেয়েদেরকে ভাল একটা স্কুলে পড়াশোনা করাবে; কিন্তু তা আর হল না। ছেলে জুনাইদ বাগদাদীর বয়স মাত্র ৫ বছর। ছেলেটা খুবই বায়না ধরে, মজা কিনে দেয়ার জন্য। সকাল হতেই ওর বায়না পূরণ করতে করতে সব টাকা শেষ হয়ে যায়। ওদের বাবা নেই, এই কথাটা মেয়ে দুটো একটু বড় বলে বুঝতে পারলেও ছেলেটা ছোট বলে বুঝতে পারে না। তাইতো সারাদিন শুধু মজা খাওয়ার জন্য বায়না ধরে। ওকে কি করে বুঝাই যে ওর বাবা বেঁচে নেই। তাই সংসারটা খুব কষ্টে চলছে।’

এর মধ্যে সোয়া ৪ বছরের ছোট ছেলে জুনাইদ বাগদাদীর সাথে কথা হলো। যাকে সোয়া ১ বছরের রেখে নিহত হয় ইব্রাহিম। জুনাইদের কাছে তার বাবা কোথায় আছে জানতে চাইলে সে বলে, ‘বাবা কবরস্তানে আছে, ঘুমিয়ে আছে। আমার কাছে আসে না, আমাকে মজা কিনে দেয় না।’ তোমার বাবা কথা মনে পড়ে জানতে চাইলে ছোট ছেলেটি অপুলক দৃষ্টিতে শুধু ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকে। কি করে বাবার গল্প করবে। সে তো তার বাবার আদর কি জিনিস সেটাই বুঝতে পারেনি। যখন বাবার আদর-সোহাগে তার বেড়ে ওঠার কথা ছিল সেই সময়ে বাবা তার পাশে নেই।

অভিমানি ছেলে জুনাইদ কিছুক্ষণ পর পর বায়না ঘরে মজা খওয়ার জন্য তাই তার মাকে বিরক্ত করে প্রতিদিন। এদিকে জুনাইদের মা হনুফা বেগম জানালেন, অভাবের সংসারে সব সময় তো টাকা থাকে না। তাই ধার-দেনা করে হলেও মজা কিনে দিতে হয়। সবার ছোট বলে ওর মরজির পরিমাণটাও একটু বেশি। এসময় মায়ের কোলে থাকা জুনাইদ মজা কিনে দেয়ার জন্য আবারো বায়না ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

ইব্রাহিমের প্রথম স্ত্রী মাহমুদা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে যদি আমাদের মেরে ফেলতো তাহলে এ দিন দেখতে হতো না। খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। স্বামীর টাকা সম্পত্তি কিছুই নাই। একটা ঘরে আমরা দুই সতিনে থাকি। আমার বাবার বাড়ি থেকে সংসারের খরচের জন্য টাকা দেয় সেটা দিয়ে চলি। সঙ্গে ছেলে মেয়ের পড়ালেখাও চলে। ছেলেটার ব্রেন ভালো। রোল ৩। টাকার অভাবে ঠিক ভাবে পড়াতে পারছি না। এসএসসি পরীক্ষা দিলে ছেলে পড়া বন্ধ করে দিয়ে কাজে লাগিয়ে দিবো। এভাবে আর চলতে পারছি না।’

ইব্রাহীমের বড় ছেলে ইসমাইল হাসান রনি বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়ার তিনদিন আগে বাবা অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারকে নিয়ে রাতে লোকনাথ মন্দিরে এসেছিল। তখন বাসায় ফোন দিয়ে বলে দাদুকে নিয়ে বাজারে যাওয়ার জন্য। তখনই শেষ বারের মতো বাবাকে দেখেছিলাম। এর পর আর দেখা হয় নাই। কথা গুলো বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল পড়ছিল রনির।

রনি বলেন, ‘আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। পরীক্ষার ফি ও স্কুলের বেতনসহ ১ হাজার ৫০০ টাকা বাবা সেই রাতে আমার হাতে দেয় আর বলেন ভালোভাবে লেখাপড়া করিস। টাকা পয়সার চিন্তা করিস না। তখন আমি বাড়ি যাওয়া কথা বললে বাবা আমাকে বলে ১৮ মে সব কাজ শেষে বেতন নিয়ে বাড়ি আসবে। বাবা আর বাড়ি আসেনি।’

রনি আরো বলেন, ‘এখন প্রতিটা মুহূর্তে বাবার কথা মনে পড়ে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যাবে। ক’দিন পরে এসএসসির টেস্ট পরীক্ষা হবে। এখন আমার বন্ধুরা ৩ থেকে ৪টা প্রাইভেট পড়ে। কিন্তু আমি পড়তে পারছি না। পরীক্ষা দেখে ক’দিন আগে গণিত ও ইংরেজি ব্যাচে গিয়ে পড়ছি। সামনে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে হবে। তখনও অনেক টাকা লাগবে। কোথায় পাবো। আমাদের তো কিছুই নেই। বাবা বলে ছিল আমি যা পড়তে চাই তাই পড়াবে। ইচ্ছা ছিলো অ্যাডভোকেট হবো। কিন্তু এখন পড়ালেখাই বন্ধ হয়ে যাবে। ছোট বোনও পড়ালেখা করে মা না খেয়ে থাকে। তাই কাজ করতে হবে। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে যে কাজ পাই তাতেই লেগে যাব।’

গোনিউজ২৪/পিআর

দেশজুড়ে বিভাগের আরো খবর
মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কোটি টাকা নিয়ে পালালো ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট

মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কোটি টাকা নিয়ে পালালো ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট

দিনের শুরুতেই বিআরটিসি বাসের চাপায় নিহত ৪ 

দিনের শুরুতেই বিআরটিসি বাসের চাপায় নিহত ৪ 

ধারের টাকা দিতে না পারায় বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ে

ধারের টাকা দিতে না পারায় বন্ধুর স্ত্রীকে বিয়ে

বোমাটি বিস্ফোরিত হলে বাসের সবাই মারা যেতেন

বোমাটি বিস্ফোরিত হলে বাসের সবাই মারা যেতেন

রেললাইনে বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা, হাতেনাতে আটক ৩

রেললাইনে বোমা বিস্ফোরণের চেষ্টা, হাতেনাতে আটক ৩

হাতকড়া পরা অবস্থায় বাবার জানাজায় বিএনপি নেতা

হাতকড়া পরা অবস্থায় বাবার জানাজায় বিএনপি নেতা