ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৪ চৈত্র ১৪৩০

‘ইসরায়েলের শত্রু’ যেসব ইসরায়েলি সেনাসদস্য


গো নিউজ২৪ | আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০১৭, ১২:২৪ পিএম
‘ইসরায়েলের শত্রু’ যেসব ইসরায়েলি সেনাসদস্য

নীরবতা শুধু একটি ইসরায়েলি রোগই না। এটা পুরো মানবজাতির মধ্যেই ব্যাপকভাবে দেখা যায়। যখন আয়নায় আপনাকে দেখতে সুশ্রী লাগবে না, তখন আপনি আর আয়নার সামনে দাঁড়াতে চাইবেন না। কথাগুলো বলছিলেন ইসরায়েলি বাহিনী ‘ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স’র (আইডিএফ) সাবেক অভিজ্ঞ কর্মকর্তা ও দেশটির দখলদারিত্ববিরোধী বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’র প্রতিষ্ঠাতা ইয়াহুদা শাউল।

ইসরায়েল সরকার কেন সমালোচনার মুখোমুখি হতে চায় না, সে প্রসঙ্গেই এসব কথা বলেন তিনি। ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরোধিতা করায় বরাবরই দেশটির সরকারের রোষাণলের শিকার এই এনজিওকর্মী। তবে গত মে মাসে ইসরায়েলের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিজপি হটভলির কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন শাউল এবং তার ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স।

মূলত ২০০৪ সালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের সেনাদের সমন্বয়ে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স প্রতিষ্ঠা করেন শাউল। এনজিওটির কাজ হচ্ছে, দখলকৃত পশ্চিমতীর, গাজা উপত্যকা এবং পূর্ব জেরুজালেমে দ্বিতীয় ইন্তেফাদা থেকে দায়িত্ব পালন করা সেনা সদস্যদের দখলদারিত্বের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা এবং তা প্রকাশ করা। অনেকে এটিকে ‘প্রতিবাদী বামপন্থি সেনাদের সংগঠন’ বলে মনে করেন। ইসরায়েল সরকার যা বলে এবং যা করে, তার পার্থক্য তুলে ধরাই তাদের কাজ।

বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে এই এনজিও। চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহুর উগ্র জাতীয়তাবাদী দল লিকুদ পার্টির সদস্য হটলভি আর্মি রেডিওকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, গাজা উপত্যকার সশস্ত্র সংগঠন হামাসের মতোই ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সও ইসরায়েলের শত্রু।

তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলের ভাবমূর্তি ঠিক রাখার সংগ্রাম হচ্ছে সবচেয়ে বড় সংগ্রাম। মিথ্যার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স ইসরায়েল এবং আইডিএফের সুনাম নষ্ট করতে চাইছে।’

ইয়াহুদা শাউল

হঠাৎ করে এনজিওটি সম্পর্কে ইসরায়েলি এই উপমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের আরও কিছু তাৎপর্য আছে। এর আগে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল নেতানিয়াহুর। হঠাৎ করে তা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী। শাউলের সঙ্গে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের এক কথা ঘোষণার পরই এই সিদ্ধান্ত আসে।

এ প্রসঙ্গে শাউল বলেন, ‘এটা নতুন কিছু না। তারা প্রায় আড়াই বছর ধরে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের বিরুদ্ধে বিষেদাগার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে ভূমি দখল এবং দখলকৃত ভূমিতে বসতি নির্মাণকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যেকোনও কিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

আগে থেকেই গ্যাব্রিয়েল জোর দিয়ে বলেছিলেন, ইসরায়েল সফরে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স এবং ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা ‘বেসেলেম’র সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ইসরায়েল সরকার। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের সাক্ষাৎ হবে ইসরায়েলের সঙ্গে অ-বন্ধুসুলভ আচরণ। তবে তা সত্ত্বেও আগের অবস্থান থেকে সরেননি জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

সম্প্রতি পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে দখলদারিত্ব বাড়ানোর নীতিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক রাজনৈতিক বিরোধিতার শিকার হয়েছে ইসরায়েল। নিজ দেশের সুশীল সমাজও সমালোচনা করেছে নেতানিয়াহু ও তার দল লিকুদ পার্টির। এদিকে নতুন করে আল আকসা মসজিদ নিয়ে পূর্ব-জেরুজালেমে শুরু হয়েছে সংকট। সেখানে তাণ্ডব চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। গুলি করা হয়েছে মসজিদের ইমামকে। এ নিয়ে এখনও তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি পশ্চিমা দেশগুলো।

মে মাসে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে ইসরায়েলকে ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল বর্ণবৈষম্যের ভিত্তিতে ফিলিস্তিনিদের ওপর এক জাতিবিদ্বেষী ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে। আগে বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েলের সমালোচনা করলেও এই প্রথম জাতিসংঘের কোনও কমিশন ইসরায়েলকে সরাসরি ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করে।

গত বছরের ডিসেম্বর দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বসতি নির্মাণকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে একটি প্রস্তাব পাস করে জাতিসংঘ। দেশটির এ ধরনের আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং তা শান্তি প্রক্রিয়ায় বাধা বলেও উল্লেখ করা হয় সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদের ওই প্রস্তাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কয়েক হাজার নতুন বসতি স্থাপনের অনুমোদন দেয় ইসরায়েল। পূর্বসূরী বারাক ওবামার তুলনায় ট্রাম্পকে অনেক বেশি ইসরায়েলবান্ধব বলে মনে করা হয়।

১৯৬৭ সাল থেকে গ্রিন লাইনে ইসরায়েলের নির্মিত সব বসতিকে অবৈধ বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। গত বছরের শেষের দিকে জাতিসংঘ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নিন্দার পরও বসতি নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে দেশটি।

এ বিষয়ে শাউল বলেন, ‘স্বাভাবিক একটা সমাজে বিরোধীদল এ ধরনের কাজের বিরোধিতা করে। আর এখানে আমাদেরই সেই কাজ করতে হচ্ছে। আমরাই তাদের বিরোধিতা করে যাচ্ছি।’

২০০১ সাল থেকে ২০০৪ সাল, এই তিন বছর আইডিএফে চাকরি করেছেন শাউল। প্রথমে আর্মি ইনফ্যান্ট্রি কোরের সৈনিক হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার চরম মুহূর্তে ডেপুটি সার্জেন্ট করে তাকে হেবরনে পাঠানো হয়। জেরুজালেমে একটি ডানপন্থি রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন তিনি। তার মতে, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় ‘ডানপন্থি’ এবং ‘বামপন্থি’ বলতে যা বোঝায়, ইসরায়েলের সমাজে তা প্রয়োগ করা যায় না। এখানে বাস্তবতা হচ্ছে আপনি বসতি স্থাপন সমর্থন করেন, কি করেন না।

শাউল বলেন, ‘আমি সব সময় সংশয়ে ছিলাম। তবে একজন মানুষের বয়স যখন মাত্র ১৮ আর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো হেবরনে, সেই পরিস্থিতিকে আসলেই আপনার ভাবার সময় থাকবে না। এখানে সেনাদের মিলিটারি লজিক, পূর্বসূরীদের অনুসরণ, নিদের্শনা মান্য করা- এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়।

বর্তমানে ৩৪ বছর বয়সী সাবেক এই সেনা সদস্যের বর্তমান অনুভূতি, আইডিএফের নীতির কারণে তাদের প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয় তার। ফিলিস্তিনিদের ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে প্রশ্ন, তাদের আটক করা, তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করা- এই কাজগুলো নিয়মিতই করে আইডিএফ।

তিনি বলেন, ‘আপনি জানেন সেখানে কী হয়? দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যখন ইচ্ছা ফিলিস্তিনিদের বাড়িতে প্রবেশ করা, তাদের প্রহরা দিয়ে রাখা- এসব করা হয়। এতে তারা ভয় আর অপমানের মধ্যে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে আমি চাকরি ছাড়লাম এবং বেসামরিক জীবনে ফিরে আসলাম। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অনুভূতিও আমার মতো। ইসরায়েল অংশ বাস করা লোকদের এ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।’

ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর নিষ্ঠুরতা

২০০৪ সালে হেবরনে দায়িত্ব পালন করা ৬৪ সেনা সদস্যের লিখিত অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন ছবি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের কাজ শুরু করেন শাউল। তার সঙ্গে থাকেন আভিয়াকি শ্যারন এবং নোয়াম চাউত। একই সঙ্গে আইডিএফ সেনা, রাজনৈতিক গোষ্ঠি এবং বেসামরিক মানুষের সমর্থনে সৃষ্ট এমন কোনো এনজিও এর আগে দেখনি ইসরায়েল। বর্তমানে একটি পরিচিত সংস্থা হয়ে উঠেছে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স। পশ্চিমতীরে প্রতিদিন কী ঘটছে, নাম প্রকাশ করে এর মাধ্যমে তার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন ইসরায়েলি সেনা।

তবে কম সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি এই এনজিওকেও। ২০১৪ সালে গাজা যুদ্ধ নিয়ে আইডিএফ সদস্যদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিল তারা। শাউল মনে করেন, দখলদারিত্ব ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্যই ‍হুমকি। দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এগিয়ে এসেছেন তারা। তিনি বলেন, ‘আজ ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি দখলদারিত্ব। এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’ এর আগে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক এক প্রধানও এ ধরনের মন্তব্য করেছিলেন।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের থেকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে সেখানে বসতি স্থাপন অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক আইনে এ বসতি স্থাপন অবৈধ বিবেচনা করা হলেও দেশটি তা মানতে নারাজ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সংঘাত চলে আসছে ওই ভূখণ্ডে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বেশ কয়েক দফায় শান্তি আলোচনা হলেও তা ব্যর্থ হয়।

পূর্ব-জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী বলে দাবি করে ইসরায়েল। অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলের দাবির কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। ওই এলাকাকে নিজেদের রাজধানী বলে করে ফিলিস্তিনিরাও। ১৯৬৭ সালে দখলকৃত পশ্চিমতীরে বর্তমানে ৪ লাখ এবং পূর্ব-জেরুজালেমে ২ লাখ ইহুদি বসবাস করছে।

গো নিউজ২৪/ আরএস

আন্তর্জাতিক বিভাগের আরো খবর
পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

পাকিস্তানের নির্বাচনে জিতে যাচ্ছে ইমরান খান-সমর্থিত স্বতন্ত্ররা

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

একসঙ্গে মরতে এসে সরে গেলেন প্রেমিকা, ট্রেনে কেটে প্রেমিকের মৃত্যু

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

তোশাখানা কী, চাঞ্চল্যকর যে মামলায় স্ত্রীসহ ফেঁসে গেলেন ইমরান খান

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

জাপানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫টি ভূমিকম্পের আঘাত

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও

ডালিম দিয়ে তৈরি আফগানিস্তানের পানীয় বিশ্বজুড়ে আলোচনায়, কিনছে আমেরিকাও

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রশ্নে যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রশ্নে যা বলছে যুক্তরাষ্ট্র