“আপনি যদি সমালোচিত না হন, তাহলে আপনি ভুল কাজটি করছেন” কথাটি বলেছেন সময়ের সবচেয়ে আলোচিত তারকা ফুটবলার নেইমার জুনিয়র।
পুরো নাম, নেইমার দ্য সিলভা স্যান্তোস জুনিয়র, সবাই ডাকে নেইমার। জন্ম: ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে।
বর্তমান ফুটবল বিশ্বের অন্যতম একজন উদীয়মান ফুটবলার মনে করা হয় তাকে। সাওপাওলোর ছোট্ট শৈল শহর মোজি দ্য ক্রুজ। বলা হয় ব্রাজিলের অন্যতম পুরনো শহর। এখনও পর্তুগিজ কলোনির ছোঁয়া রয়েছে শহরের আনাচে-কানাচে। আর মোজিকে ঘিরে সোহা দোয়েতাপাচি পর্বতমালা। পাহাড়ের মাথায় জমে রয়েছে মেঘ। ঠিক এই পাহাড়ের নিচেই থাকতেন নেইমার।
খুব ছোট্ট একটা অতি সাধারণ হাউজিং কমপ্লেক্স। ওই জায়গাটার নাম হোডেও। ফুটবল খেলে টাকাপয়সা জমিয়ে এখানেই একটা ফ্ল্যাট আর গাড়ি কিনেছিলেন নেইমার সিনিয়র। স্থানীয় ইউনিনিও (ইউনিয়ন) ক্লাবে খেলতেন নেইমারের বাবা। এলাকায় বেশ নামী সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিলেন। মোজির স্থানীয় লিগে রীতিমতো স্টার ফুটবলার ছিলেন তিনি। নেইমার জুনিয়র তখন খুব ছোট। বাবার হাত ধরে যেতেন খেলার মাঠে। গ্রুপ ছবিতে বসে যেতেন। বাবার বন্ধুদের সঙ্গে বল পেটাতেন।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। নতুন কেনা গাড়িতে মোজি থেকে সান্তোস যাচ্ছিলেন নেইমার সিনিয়র। সঙ্গী স্ত্রী ও পুত্র। রাস্তায় বিরাট একটা দুর্ঘটনা। প্রাণে বেঁচে যান সবাই। কিন্তু নেইমার সিনিয়রের গোড়ালি ভাঙে। ব্যস্, ফুটবল জীবনের শেষ ওখানেই। সব স্বপ্নেরও ইতি।
কিন্তু ওপর ওয়ালা যে অনেক বড় স্বপ্ন সাজিয়ে রেখেছেন তার জন্য। আদৌ কি তা ভাবতে পেরেছিলেন নেইমার সিনিয়র? সান্তোসেই যে ফুটবল জীবনের পরিপূর্ণতা লাভ করবে নেইমার জুনিয়রের। খুব ছোটবেলায় চোখে পড়ে যান স্যান্টোস স্কাউটিং ডিপার্টমেন্টের। একজন সফল ফুটবলারদের উপস্থিতি বদলে দিতে পারে একটা ক্লাবের সব ব্যবসায়িক সমীকরণ।
উদাহরণ হিসেবে নেইমারের কথাই বলা যাক। মাত্র ১১ বছর বয়সে রিয়াল মাদ্রিদ তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সান্তোস ছাড়েনি। তার ঠিক দশ বছর পর বার্সেলোনাকে বিক্রি করল ৫৭ মিলিয়ন ইউরো।
পেলের মতো সান্তোসের মিউজিয়ামে নেইমারের জন্যও আলাদা একটা শো-কেস করা আছে। সেখানে দেখানো হচ্ছে নেইমারের গোল, তার অটোগ্রাফ করা জার্সি, বুট, ব্যালন ডি’অরে পুসকাস পুরস্কারের ফলক সবটাই এখনও সাজিয়ে রেখেছেন স্যান্টোস কর্তৃপক্ষ। কারণ এক বারও বিশ্বকাপ না জিতে নেইমার এই মুহূর্তে যে রকম জনপ্রিয়তা, স্টারডম ভোগ করছেন, তা পেয়েছিলেন একমাত্র পেলে!
নেইমারের আলোচনায় উঠে আসার গল্প
সান্তোসের হয়ে প্রথম দিকে খুব বেশি সফলতা অর্জন করতে পারেননি নেইমার। ২০০৯ সালের ১১ই এপ্রিল ব্রাজিলিয়ান কাপের শেষের দিকে সুযোগ পেয়ে সেমিফাইনালে পালমেইরাসের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করেও সান্তোসকে ফাইনালে তুলতে পারেননি। পরের মৌসুমে সুযোগ পেয়েই ঝলসে উঠলেন। ২০১০ সালের ব্রাজিলিয়ান কাপের শিরোপার সাথে সাথে অর্জন করেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও। এই লিগে নেইমার ১৯ খেলায় ১৪ গোল করেন। সে সময়ই চারিদিকে নেইমার নেইমার রব পড়ে যায়। নেইমারের নৈপুণ্যে সান্তোস ব্রাজিলিয়ান লিগ কাপ আর কোপা লিবার্তাদোরেসের ট্রেবল শিরোপা অর্জন করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাজিলিয়ানরা নেইমারকে পেলের উত্তরসূরি হিসেবে ভাবতে শুরু করে এবং ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ হয় নেইমারের।
মেসিদের সাথে বার্সেলোনায়
ব্র্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার ২০১৩ সালে সান্তোস থেকে ৫৭ মিলিয়ন ইউরোতে বার্সায় যোগদেন। ৩-রা জুন ২০১৩, মেডিকেল চেক-আপ এবং অন্যান্য ফর্মালিটি শেষ করে নেইমার দর্শক ও মিডিয়ার সামনে আসেন। পেলের উত্তরসূরীকে স্বাগত জানাতে ন্যু ক্যাম্পে সেদিন রেকর্ড পরিমাণ ৫৬,৫০০ দর্শকের সমাগম হয়।
পেলে একসময় নেইমারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সারা জীবন সান্তোসেই থেকে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কে না জানে, পেশাদার ফুটবলের জগৎটা এমনই কঠিন যে এখানে খেলোয়াড়রা চাইলেও আসলে উপেক্ষা করতে পারে না অনেক কিছু। এরই ফলশ্রুতিতে সমেয়র সেরা এই স্ট্রাইকার ২০১৩ সালে পোল্যান্ডের ক্লাব লেসিয়া দানস্কের বিরুদ্ধে প্রীতি ম্যাচে বার্সেলোনার হয়ে মাঠে নামেন। তার পরের ইতিহাসটা তো সবারই জানা।
বার্সেলোনায় থাকাকালীন অর্জন
লা লিগা (২): ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬
কোপা দেল রে (৩): ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭
স্পেনীয় সুপার কাপ (১): ২০১৩
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ (১): ২০১৪-১৫
ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ (১): ২০১৫
পিএসজিতে নতুন অধ্যায়
শেষ পর্যন্ত বার্সাতেও থাকলেন না ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার নেইমার। এবার যোগ দিলেন ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে। এব্যপারে বিবিসির দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবল সংবাদদাতা টিম ভিকারি ব্যাখ্যা করছিলেন, এর পেছনে কি কি হিসেব কাজ করে থাকতে পারে।
তিনি বলছেন, নেইমারের ক্যারিয়ার সব সময়ই এগিয়েছে ধাপে ধাপে - যার চূড়ান্ত লক্ষ্যগুলো একটি হলো ফিফার বর্ষসেরা খেলোয়াড় বা গোল্ডেন বল পুরস্কার জেতা। আপনি ইতিহাস দেখলে দেখবেন, ১৯৯৪ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত পাঁচজন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় আট বার ওই পুরস্কার জিতেছেন। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কোথায় পৌঁছাতে হবে - তার জন্য এটা বলা যায় একটা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাই নেইমার যদি এই গোল্ডেন বল না জেতেন - তাহলে ধরে নেয়া হবে তিনি সেই স্তরে উঠতে পারেন নি। এখন, তিনি যদি তার দলে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়া্ড় না হন -তাহলে তিনি এ পুরস্কার জিততে পারবেন না।
মি. ভিকারির কথায়, নেইমার ইউরোপে খেলতে এসেছেন ২০১৩ সালে যখন তার বয়েস ২১। হয়তো তিনি তার আগেও ইউরোপে আসতে পারতেন। কিন্তু তাকে গড়ে তোলা হয়েছে এমনভাবে যাতে তিনি বার্সেলোনায় লিওনেল মেসির পাশাপাশি খেলার সুযোগ পান - যাতে তিনি সেরা হিসেবে গড়ে উঠতে পারেন। কিন্তু নেইমারের এক নম্বর হয়ে উঠতে গেলে তাকে হয় মেসিকে ছাড়িয়ে যেতে হবে, নয়তো মেসিকে বার্সেলোনা থেকে চলে যেতে হবে, বা নেইমারকেই অন্য কোথাও যেতে হবে। যেহেতু প্রথম দুটো হয় নি তাই নেইমারই এখন বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে গেলেন।
পিএসজিতে এখন পর্যন্ত কোন কাপ না জিতেলও, ২৬ ম্যাচ খেলে ২৭ গোল এবং সাথে ১৬টি এসিস্ট রয়েছে নেইমারের।
বর্তমানে ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার নেইমার
ব্রাজিলে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার এখন নেইমার জুনিয়র। দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল পরাশক্তি ব্রাজিলের মাটিতে সম্প্রতি চালানো এক সমীক্ষা থেকে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সমীক্ষায় দেখা যায়-শতকরা ৩২.১ ভাগ ভোট পেয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলারের তকমাটা জিতে নিয়েছেন পিএসজি তারকা প্লেমেকার নেইমার।
এক নজরে
পুরো নাম : নেইমার দ্য সিলভা সান্তোস জুনিয়র
ডাক নাম : নেইমার
জন্ম : মগি দা ক্রুজ, সাও পাওলো, ব্রাজিল, ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২
পেশাদার ফুটবলে অভিষেক : মার্চ, ২০০৯
জাতীয় দলে অভিষেক : জুলাই, ২০১০
ব্যক্তিগত অর্জন:
ক্লাব সান্তস চ্যাম্পিওনাতো পৌলিস্তা (৩): ২০১০, ২০১১, ২০১২
বার্সেলোনা সুপারকোপা দে স্পানা ( ১): ২০১৩
জাতীয় দল ব্রাজিল দক্ষিণ আমেরিকান যুব চ্যাম্পিয়নশিপ ( ১): ২০১১
সুপার ক্লাসিকো দে লাস আমেরিকাস (২): ২০১১, ২০১২
অলিম্পিক রৌপ্য পদক (১): ২০১২
ফিফা কনফেডারেশন্স কাপ ( ১): ২০১৩
দক্ষিণ আমেরিকান যুব চ্যাম্পিয়নশিপের সেরা খেলোয়াড় ( ১): ২০১১
ফিফা কনফেডারেশন কাপের গোল্ডেন বল (১): ২০১৩
বর্ষসেরা যুব খেলোয়াড় ( ১): ২০১১
গোল্ডেন বুট (৩): ২০১০, ২০১১, ২০১২
দক্ষিণ আমেরিকান যুব চ্যাম্পিয়নশিপের সর্বোচ্চ গোলদাতা ( ১): ২০১১
ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ব্রোঞ্জ বল (১): ২০১১
বর্ষসেরা দক্ষিণ আমেরিকার খেলোয়াড় (২): ২০১১, ২০১২
ফিফা পুস্কাস পুরষ্কার (১): ২০১১
ফিফা কনফেডারেশন কাপের ব্রোঞ্জ স্যু (১): ২০১৩
ফিফা কনফেডারেশন কাপের ড্রিম টিম ( ১): ২০১৩
২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রোন্জ বুট
মাত্র ২৬ বছর বয়সে জীবনের সবকিছুই অর্জন করেছেন নেইমার , এখন শুধু ব্যালন ডি অ’র আর বিশ্বকাপ বাকি, আশা করা যায় খুব শিগগিরই সে স্বপ্নও পূরণ করবেন নেইমার। তথ্যসুত্র: বিবিসি,উইকিপিডিয়াি এবং ইন্টারনেট
গোনিউজ২৪/এমএফ