ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশ কি চলছে?


গো নিউজ২৪ | আনিসুল হক প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৮, ২০১৭, ১০:০০ এএম
দেশ কি চলছে?

আনিসুল হক: যানজটে ঢাকায় রোজ ৩২ লাখ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়ঢাকা শহর যেভাবে চলছে, তাকে কি চলা বলে? ৩০ মিনিটে এলাম সিলেট থেকে ঢাকায়, আকাশপথে, তারপর বিমানবন্দর থেকে ১৫ কিলোমিটার পথ আসতে লাগল চার ঘণ্টা! এটা কি চলা বলে? শুধু কি ঢাকার ভেতরে? সারা দেশেই কি সড়কগুলোর অবস্থা খারাপ নয়? ঢাকা থেকে গাজীপুরে যেতে কতক্ষণ লাগবে, কেউ বলতে পারে না। সড়কপথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাবেন? সিলেট, খুলনা, রংপুরে যাবেন? বাস কখন পৌঁছাবে, কেউ জানে না।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, যানজটে ঢাকায় রোজ ৩২ লাখ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। যানজটের বার্ষিক ক্ষতি ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর বিনিয়োগ বোর্ড বলছে, ঢাকার যানজটে ক্ষতি বছরে ১ লাখ কোটি টাকা।

ঢাকা আসলে চলছে না। একে চলা বলে না।

বলতে পারেন, গতকাল কি অফিসে যাননি? অফিস থেকে কি বাড়িতে পৌঁছাননি? নিজের বিছানায় ঘুমোননি? তাহলে চলছে তো! আমি বলি, পাঁচ বছর পরে এই চলাও চলবে না। ১৫ বছর পরে এই শহরকে অচল, পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। বলতে হবে, একদা এক নগর ছিল ঢাকা নামে।

আমরা মধ্য আয়ের দেশ হচ্ছি। আমাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে। মধ্যবিত্ত বড় হচ্ছে। সংগতি হলেই আমরা গাড়ি কিনব। প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়ি নামছে রাস্তায়। ঢাকা শহরে রোজ মানুষ আসছে। অক্সফামের এক হিসাবে বলা হয়েছে, রোজ চার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসতে বাধ্য হচ্ছে, কেবল জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষতির কারণে। শিক্ষার হার বাড়ছে, তা-ও আমাদের চলাচল বাড়াবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ছে, তা-ও মানুষ ও পণ্যের চলাচল বাড়াবে। ঢাকা শহরে আরও লোক আসবে, গাড়ি আসবে, ট্রাক চলবে। বড় বড় ভবন হবে। জমি বাড়বে না। কাজেই ঢাকা শহর চলবে না।

এমন না যে পরিবহন খাতে কাজ হচ্ছে না। হাজার হাজার কোটি টাকার বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। তাতে কোথাও কোথাও আমরা উপকারও পাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জ থেকে পলাশী আসতে কখনো কখনো খুব কম সময় লাগে। কারণ উড়ালসড়ক। পূর্বাচল কিংবা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যাতায়াতও অনেক সহজ হয়েছে উড়ালসড়কের কারণে। কিন্তু পূর্বাচল যখন চালু হবে, তখন ওই সরু উড়ালসড়কে ওঠার জন্য মাইলের পর মাইল যানজট বাঁধবে। আমরা কেন পরিকল্পনা করার সময় ভবিষ্যতের কথা ভাবি না?

আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তিনটা উড়ালসড়ক বানালাম। একটা র‍্যাংগস ভবন ভেঙে, একটা হাতিরঝিলথেকে সোনারগাঁও হোটেলের কাছে, একটা মগবাজার হয়ে বাংলামোটরের আগে। তিনটা উড়ালসড়কই ভিআইপি সড়কের আগে নামিয়ে দেওয়া হলো। এখন তিনটা উড়ালসড়কই ভিআইপি সড়কের যানজট বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না যে ভিআইপি রোড পার করে না দিলে উড়ালসড়কগুলো আদপে কোনো কাজে লাগবে না।

চট্টগ্রামে নাসিরাবাদ স্কুলের পাশে একটা হোটেলে ছিলাম। নিচে উড়ালসড়ক। তাকিয়ে দেখি, উড়ালসড়ক ফাঁকা। উড়ালসড়কের নিচের রাস্তায় জট। স্থানীয় মানুষকে জিগ্যেস করলাম, ব্যাপার কী? তাঁরা বললেন, ‘এই ফ্লাইওভার যেখান থেকে ওঠে আর যেখানে নামিয়ে দেয়, তা আমাদের কোনো কাজে লাগে না। আমরা তাই নিচ দিয়েই চলি।’

শুনে আমার রক্ত হিম হওয়ার উপক্রম। এটা কি সত্য? কোটি কোটি টাকা খরচ করে যা বানাচ্ছি, তা মানুষের কাজে আসছে না? ইত্তেফাক-এ ৮ অক্টোবর প্রকাশিত খবরের শিরোনাম: চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার ফাঁকা, নিচে সড়কে যানজট।

আরও আছে। মৌচাক–মগবাজার উড়ালসড়কের কাজ অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর খবর পাওয়া গেল, এই নকশা আসলে আমেরিকান গাড়ির জন্য, যারা রাস্তার ডান দিক দিয়ে গাড়ি চালান। আমরা চালাই রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে। কাজেই এটা কেঁচেগণ্ডূষ করতে হবে। এরপর দেখা গেল, নকশায় বড় ত্রুটি। বিদেশি বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন দিলেন। বললেন, এই নকশা স্টান্ড্যার্ড অনুযায়ী হয়নি। তখন বুয়েটকে দেওয়া হলো নকশা। তারা দেখল, নকশায় ত্রুটি আছে। সেই ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে।

ডান পাশ, বাঁ পাশের অভিযোগ স্বীকার করা হয় না। কিন্তু প্রকৌশল নকশায় সমস্যা ছিল, তা বুয়েট ঠিক করে দিয়েছে, এটা আমাকে নিশ্চিত করেছে একটা নির্ভরযোগ্য সূত্র। টেকনিক্যাল ডিজাইন সবাই বুঝবে না। তাই একটা নকশা হয়ে গেলে তৃতীয় বিশেষজ্ঞ পক্ষকে দিয়ে নিরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে, এটাও কি বলে দিতে হয়? কাজ আরম্ভ করে অনেক সময় ও টাকা নষ্ট করে, মানুষকে অনেক ভুগিয়ে তারপর হুঁশ হলো, নকশায় ত্রুটি আছে।

হায়, খোদা। খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। এটা কি ছেলেখেলা? কোটি কোটি টাকা, সময়, দুর্ভোগ না হয় কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষের জীবনও কি মূল্যহীন, প্রভু?

এরপর আসছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এটা কি ঠিক আছে? এটা চালু হওয়ার পর একইভাবে আমরা কি অরণ্যে রোদন করব? মাথার চুল ছিঁড়ব? হায় হায়, আগে বলেননি কেন?

ঢাকা শহরে এবং সারা দেশে পরিবহন নিয়ে যা হচ্ছে, তা হলো জোড়াতালি। খেয়াল–খুশি। আরেকটা হচ্ছে, বিভাগে বিভাগে, দপ্তরে দপ্তরে, কর্তৃপক্ষে কর্তৃপক্ষে প্রকল্প করার প্রতিযোগিতা। কোনো জাতীয় দর্শন বা পরিকল্পনা নেই।

নেই মানে, কাজীর গরু কাগজে আছে, গোয়ালে নেই। আর আছে নিধিরাম সরদার। আমাদের একটা কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা ছিল। অনেক টাকা খরচ করে এটা তৈরি করা হয়েছিল। একে বলে, এসটিপি। স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান। এবার করা হয়েছে, রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যান। পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণাও করেছেন, আরএসটিপির বাইরে কোনো কিছু করতে দেওয়া হবে না।

হবে না, তবে অনেকগুলো হয়ে গেছে। এখন সুফল পেতে তেজগাঁও, পূর্ব পান্থপথ, মগবাজারের উড়ালসড়ক ভাঙতে হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যাওয়ার পর কোনটা কোনটা যে আবার ভাঙতে হবে, আবার গড়তে হবে, কে জানে।

পরিবহন নিয়ে জাতীয় দর্শন চাই। এক. ঢাকাকেন্দ্রিকতা কমাতে হবে। কেন চিকিৎসার জন্য, শিক্ষার জন্য ঢাকায় আসতেই হবে? কেন উপজেলা শহরগুলো স্বনির্ভর হবে না? কেন চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না? বরিশাল নৌ রাজধানী হবে না? রাজশাহী ধরা যাক চিকিৎসার শহর হলো। দিনাজপুর শিক্ষার শহর।

দ্বিতীয়ত, আমরা কেন নৌপথ ও রেলপথকে গুরুত্ব দিচ্ছি না? নিউইয়র্কেও যানজট হয়, লন্ডনেও হয়। রাস্তার নিয়মই হলো, আপনি যত বড় রাস্তাই বানান না কেন, গাড়ির সংখ্যা রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হবেই। কাজেই নিরুপদ্রব চলাচলের জন্য আপনাকে রেলপথ ব্যবহার করতে হবে। নৌপথ ব্যবহার করতে হবে।

আমাদের সমন্বিত দূরদর্শী টেকসই পরিবহন পরিকল্পনা লাগবে। দরকার হবে সমন্বয়। ধরা যাক, আজকে সিটি করপোরেশন একটা পদচারী–সেতু বানাল, কালকে এলিভেটেড ওয়ে বানাতে গিয়ে সেতু কর্তৃপক্ষকে সেটা যেন ভাঙতে না হয়। আমাদের ঠেলাঠেলির ঘর। যতটুকুন আছে, তা খোদা রক্ষা করেছেন বলে।

আমাদের একটা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ আছে বটে। তাতে জনা ষাটেক কর্মচারী, এর মধ্যে কারিগরি লোক আছেন ১১ জন, পরিবহন প্রকৌশলী আছেন ১ জন। এই সংখ্যা সামান্য এদিক-ওদিক হতে পারে, তাতে অবস্থার হেরফের হয় না। তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, এমনকি তারা সরদারও নয়। তাদের কথা কেউ শুনবে না, শোনেনি, শোনার কোনো কারণও নেই।

এখনই এই শহর বসবাসের অনুপযুক্ত শহরের বিশ্ব তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। কদিন পরে এই শহর চলবে না, চলতে পারে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. শামসুল হক তাই জোর দেন একটা পরিবহন–দর্শন, রূপকল্প মান্য করার ওপরে। সমন্বয়হীনতার বদলে তিনি চান সমন্বয়। আর যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে জনগণের মত গ্রহণের ওপর তিনি জোর দেন।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ঢাকা শহরের ভেতরে উড়ালসড়ক নির্মাণের বিরুদ্ধে। একই কথা বলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। আমি আরও পরিবহন প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেন, শহরের ভেতরে সাধারণত উড়ালসড়ক হয় না। মগবাজারে–মৌচাকে উড়ালসড়কের নিচে যাঁদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে, তাঁদের অবস্থা এখন কী? দোকানে লোক যায়? অন্ধকারে তাঁদের মুখেও কি অন্ধকার নেমে আসেনি? ভেবে দেখেছি, তাই তো, এত যানজট, তবু তো ম্যানহাটনে উড়ালসড়ক নেই।

এটা অন্য বিতর্ক। কিন্তু আমাদের এরই মধ্যে চালু হয়ে যাওয়া উড়ালসড়কের নিচের জায়গাগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হবে, তারও তো কোনো মীমাংসা হয়েছে বলে মনে হয় না। কোথাও সেটা ভাগাড়, কোথাও আস্তাবল, কোথাও আস্তাকুঁড়।

কিন্তু ঢাকাকে কি বাসযোগ্য রাখা সম্ভব নয়? বাংলাদেশকে কি চলাচলের উপযোগী রাখা যাবেই না? সম্ভব, যদি পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা থাকে। আমাদের সামর্থ্য আছে, লোকবলও আছে, দরকার বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে এটার সমাধান করার সদিচ্ছা। এর জন্য আমার প্রস্তাব হলো:

এক. প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিবহন-সংক্রান্ত একটা জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা। সেটা নির্বাহ করার জন্য একজন দূরদর্শী, সক্ষম, অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেওয়া। বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের অভিজ্ঞতার জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর পরামর্শ
নেওয়া যেতে পারে। তাঁরা সারা দেশের কনটুয়ার মানচিত্র, স্যাটেলাইট মানচিত্র, জনমিতি, ভূগোল, স্থানীয় বৈশিষ্ট্য, নদ-নদী, পানির প্রবাহ, বন্যা, অর্থনৈতিক চাহিদা বিবেচনা করে একটা জাতীয় পরিবহন পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। অবশ্যই আরএসটিপিকে অগ্রাধিকার দেবেন।

দুই. নৌপথ চালু করতে হবে। রেলপথকে গুরুত্ব দিতে হবে। সড়ককাঠামো দূরদর্শী করতে হবে। বিমানবন্দরগুলোকেও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। কেন ঢাকা-চট্টগ্রাম দ্রুতগামী রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে না?

পরিবহন-সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি সব সংস্থা, দপ্তর, মন্ত্রণালয়, কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয় করবে। তারা আমাদের দেখাবে আশু সমাধানের দিশা, দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকনির্দেশনা।

বহু গবেষণা কিন্তু এর মধ্যে হয়েছেও। বহু পরিকল্পনা দিস্তা দিস্তা কাগজে রয়েও গেছে। সেসবের সমন্বয় দরকার। আর দরকার নীতিমালাকে বাস্তবে কাজের সময় গণ্য করা, মান্য করা। সেটা করা হচ্ছে কি না, তা তদারক করা। যখন যার ইচ্ছা হলো, রাজনৈতিক প্রণোদনায় একটা প্রকল্প নেওয়ার প্রথাটা বন্ধ করা।

আসুন, বাংলাদেশকে চলতে দিই। আমরা কেউ চাই না, ঢাকা অচল থাকুক। আমরা কেউ চাই না, দেশ অচল হয়ে পড়ুক।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

গোনিউজ২৪/কেআর

মতামত বিভাগের আরো খবর
নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

নারীরা,মনের দাসত্ব থেকে আপনারা কবে বের হবেন?

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস ও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

সুচন্দার কষ্টে আমরাও সমব্যথী

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

প্রিন্টমিডিয়ার অন্তর-বাহির সংকট

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো দরকার যেসব কারণে

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

সিলেটের শীর্ষ শিল্প উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ